শ্রাবন্তী ঘোষাল

যে আমাকে দু’বেলা খেতে দেবে
সে আমার কাছে মা দুর্গা।
আজ শরৎভোরে মনে হয়
সিংহে চড়ে এসে সে আমাকে খেতে দেয়।
সিংহ বসে থাকে দোরের বাইরে––
তার কেশরের মতো আশ্বিনের রোদ্দুরের মধ্যে।
মা আমাকে শিউলি পাতার বড়া আর
মৌরলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত দেন।
ভরা পেটে শরতের আকাশ দেখতে দেখতে ঘুম পায়
সুদর্শনচক্রের মতো সূর্যের গায়ে ছায়া ফেলে
মেঘ পালাচ্ছে দিগবলয়ে, টুনটুনিরা বেগুনখেত ছেড়ে
নড়তে চায় না।
আমি সুর করে গাই, যে আমাকে দু’বেলা খেতে দিচ্ছে
সে আমার কাছে মা দুর্গা।
(শরৎ/মণীন্দ্র গুপ্ত)

দুর্গাপুজো আসার মুখে রাস্তা জুড়ে ‘বাঙালি’ খাবারের রেস্তোরাঁর বিজ্ঞাপন আর হোয়াটস্যাপের মেসেজ বাক্সে ক্লাউড কিচেনের পুজোর থালি বুক করার অফারের আহ্বান, ফেসবুকের মার্কেট প্লেসে পুজোর দিনের নাড়ু-মোয়া-তক্তি-ছাপা সন্দেশের মারকাটারি অফারের বার্তায় চোখ রাখতে রাখতে মনে হয় উৎসবের ব্যাপ্তি কেমন যেন ছোট ছোট স্ক্রুপ আঁটা বাক্সে ভরা হয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ইত্যাদির চক্করে বাঙালি হিন্দুর প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো একটি পণ্যে রূপান্তরিত। দুর্গাপুজো দেখতে জেলা থেকে শহরে আসতে হয়, শহর থেকে লং ড্রাইভে গ্রামের পুজো ট্যুরিজম করতে হয়, চলতি পথে হাইওয়ের ধারের কাশফুলের পাশে দাঁড়িয়ে সেল্ফি তুলতে হয়, রাজবাড়ির পুজো, বিখ্যাত পুজো দেখতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়, কলকাতা জেলার প্রচলিত পদ দিয়ে সাজানো দুপুরের ভাত খাওয়াকে ‘বাঙালি থালি’ নামাঙ্কিত করা হয় এমন জায়গায় বুফেতে খেয়ে রেস্টুরেন্ট তথা কর্পোরেট হিন্দুত্বের জয়গান গাইতে হয়। এমন নানাবিধ আচার মেনে চলতে হয়। অবশ্য সত্যিকারের ধর্মীয় আচারও এই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত। লাল পাড় সাদা শাড়ি, শাঁখা-পলা-আলতা-সিঁদুর অথবা ডিজাইনার রেডিমেড ধুতি আর পাঞ্জাবি শোভিত হয়ে মহাষ্টমীর মেগা অঞ্জলি পর্ব আর পুজো শেষে সিঁদুর খেলা। এছাড়াও এ কদিনে চোখ রাখতে হয় বনেদি বাড়ির পুজো লাইভে, যাদের শতাব্দীপ্রাচীন সোনার গয়না, আভিজাত্য, ঔপনিবেশিক শাসকের দাসত্বের ইতিহাস দুর্গোৎসবের সামাজিক ইতিহাসের সরলীকৃত রূপ তৈরি করতে ঘামতেলের জোগান দিয়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের সময় থেকেই মনসা ও চণ্ডীর পূজা পৌরাণিক নয়, লৌকিক দেবী হিসাবে বাংলায় শুরু হয়েছিল। সাহিত্যকে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গণ্য করলে দেখা যায়, ষোড়শ শতকের শেষ থেকেই চণ্ডীর পুজোর ব্যাপক প্রচলন হয়। সেই চণ্ডীর নাম অভয়া, অন্নপূর্ণা ইত্যাদি। তিনি শিবের ঘরনি। এই শিব ভিখারি কিন্তু ভোজনবিলাসী। তার সাথে ঝগড়া করে তাকে শায়েস্তা করার জন্য উমা শুধুমাত্র নিরামিষ ব্যঞ্জন রান্না করেন। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আশ্বিনের নবরাত্রি থেকে অকাল বোধনের আখ্যান সূত্রে শারদীয় দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল বলে একটা ঐতিহাসিক ধারণা পাওয়া যায়। সেই দেবী শুধু সিংহের পিঠে বসা মহিষাসুরমর্দিনী নন, অর্ধবৃত্তাকার পটের ছবি আঁকা চালচিত্রে একই কাঠামোয় তাঁর সাথে পূজিত হন তাঁর কন্যা হিসাবে পরিচিত লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দুই পুত্র গণেশ ও কার্তিক। এঁরা সবাই নিজস্ব বাহনে চেপে আসেন। বলা বাহুল্য দুর্গার সন্তান হিসাবে এই চারজন দেবদেবীকে নিয়ে মায়ে-পোয়ে-ঝিয়ে দুর্গাপুজো একান্ত বাঙালিরই কল্পনা। সপ্তসতী বা অন্যান্য পুরাণের আখ্যানে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। পরিবার যে আরাধনার সাকার মূর্তির কল্পনার আকর, সে আরাধনায় বাঙালি সমাজচিন্তা ও ভাবনার জয়জয়কার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সমুজ্জ্বল।

কলকাতা ও তার আশপাশের সামন্ত রাজা, জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো প্রচলিত হবার পর অর্থকৌলীন্যের কারণে খ্যাতি লাভ করলেও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে পারিবারিক পরিসরে আয়োজিত পুজোর ইতিহাস দেশভাগ পরবর্তী সময়ে প্রায় হারিয়ে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কারণে দেশ ছেড়ে আসা মানুষের পুঁটলিতে কোশাকুশি, পিলসুজ, জলশঙ্খ, পাথরের থালা, তক্তি বানানোর মাটির ছাঁচ জায়গা পেলেও ওপারে পড়ে থাকা পুকুরের শাপলা, ওশের (কুয়াশার) জল, দুর্গাচচ্চড়ি, ঢাকের বোল, গ্রামের পটুয়ার হাতে তৈরি দুর্গার মুখের ছাঁচ, পুজোর দিনে পংক্তিভোজনের আনন্দের স্থান এখন তাই শুধুমাত্র স্মৃতিতে।

পূর্ববাংলার প্রধান শহর ঢাকা ও ঢাকা জেলার প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ বিক্রমপুর অঞ্চল বিদ্যাবুদ্ধির চর্চার জন্য খ্যাত ছিল। মানুষের মুখে মুখে বানানো ছড়ায় তার প্রমাণ মেলে — “জ্ঞান, বুদ্ধি, টাকা তিন নিয়ে ঢাকা”। বিক্রমপুর ছিল এক পরগনা, যা পরবর্তীকালে মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। তার পাশে বয়ে চলেছে পদ্মা। অতীশ দীপঙ্কর, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মত মানুষের আদি নিবাস এই অঞ্চলে দুর্গাপুজো অষ্টাদশ শতক থেকেই প্রচলিত। জমিদার বাড়ি ছাড়াও শিক্ষিত, বিদ্যানুরাগী ব্রাক্ষ্মণ পরিবারেও শারদীয়া দুর্গাপুজোর আয়োজন হত। তেমন পরিবারের আয়োজনে বাহুল্য বা জৌলুস না থাকলেও ছিল তা ভক্তি, নিষ্ঠা আর দেবী দুর্গাকে নিজের মেয়ে কল্পনা করে আপ্যায়নের আন্তরিকতা।

নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গের এই অঞ্চলে বর্ষাকালের পরে বন্যার জলে মাঠঘাট, ঘরবাড়ি, কাঁচা রাস্তার অশেষ দুর্গতি অবধারিত ছিল। যেহেতু জলপথ ছাড়া  একবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহন প্রায় অসম্ভব ছিল, সেহেতু পুজোর আয়োজনে দূর শহর থেকে আনা জিনিসের চেয়ে নিজেদের গ্রামের ও আশেপাশের অঞ্চলের জিনিসপত্রের উপরেই ভরসা করতে হত। ব্রাহ্মণ পরিবার ছাড়া ভাত ও লবণ দিয়ে রান্না করা ব্যঞ্জন দেবীর ভোগের জন্য নিবেদন করা যাবে না, এমন নিদানের কথা প্রায় সবার জানা। কিন্তু ভাতের সাথে হরেকরকম মাছের পদ দিয়ে পুজোর চারদিন দেবীর ভোগ রান্না নদীর পারের দেশের মানুষের পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

চণ্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দরামের রচনায় এমনি মাছ রান্নার প্রমাণ মেলে

কটু তেলে রান্ধে রামা চিতলের কোল।
রুহিতে কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল।।
কটু তেলে কই মৎস্য ভাজে গণ্ডা দশ।
মুঠি নিঙারিয়া তথি দিলা আদারস।।
বদরি শকুল মীন রসাল মুশুরি।
পণ চারি ভাজে রামা সরল-সফরি।।
কতগুলি তোলে রামা চিংড়ির বড়া।
ছোটছোট গোটা চারি ভাজিল কুমুড়া।।

এছাড়াও মনসামঙ্গলে উল্লিখিত পুঁটি, খলিসা, কই, বোয়াল, চিংড়ি, শোল, রুই, ইলিশ মাছের সর্ষে দিয়ে পদ দেবীর ভোগের জন্য প্রতিদিন রান্না হত।

যে কোনো উৎসবের মূল আকর্ষণ ভাল খাবার দাবার। বন্যা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য ভাত, ডালটুকু জোগাড় করাই একসময় সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। পেট ভরে খাবার খাওয়ার মধ্যেই তাদের উৎসবের আনন্দ।

পুজোর বাড়িতে  জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অভ্যাগতদের মধ্যে অন্ন প্রসাদ বিতরণের জন্য যে পংক্তিভোজনের আয়োজন করা হত, সেখানে সবার জন্য মাছের সংকুলান করা প্রতিবার সম্ভব হত না। তাই ভাতের সাথে একাধিক ডাল পরিবেশিত হত। উচ্ছে, করলা, মুগ ডাল দিয়ে তিতার ডাল, জিরে ফোড়নে ভাজা মুগ ডাল দিয়ে ঝালের ডাল অথবা নারকেল কুচি দেয়া ছোলার ডাল, আমসি (শুকনো আমের কুচি), করঞ্জা, জলপাই, চালতা ইত্যাদি টক ফল ও মটর ডাল দিয়ে রান্না করা পাতলা টকের ডাল (যার নাম ছিল ‘হাত ধোয়া, পাত ধোয়া ডাইল’) – মোটামুটি এই তিনরকম ডাল রান্না করা হত। বলা বাহুল্য ধান আর ডাল চাষের পরে ফসল তোলার সময় সারা বছরের চাল, ডাল ঘরে মজুত করে রাখা হত।

শুধু ডালভাতে তো গণভোজন সম্পন্ন হয় না, আরও কিছু ব্যঞ্জন চাই। কিন্তু বন্যার পরে সবজির জোগান তেমন নেই, পড়ে আছে শুধু চালকুমড়ো, মিষ্টি কুমড়ো আর ওল। রুই আর ইলিশ মাছের মাথা, দুরকম কুমড়ো দিয়ে তৈরি হত এক চচ্চড়ি যা শুধুমাত্র পুজোর সময় রান্না হত বলে তার নাম হয়েছিল দুর্গাচচ্চড়ি। একইভাবে মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা হত ওলের তরকারি। এছাড়াও ছিল আগের বছরের শীতে শুকিয়ে রাখা বাঁধাকপির ঘন্ট। সেকালে হিমঘর কল্পনাতেও ছিল না। শীত শেষে বাধাঁকপি কেটে হলুদ মাখিয়ে শুকিয়ে রাখা হত। দশ হাতের মেয়ে ঘরে আসে শুধু শরতে, তার জন্যই এই আয়োজন।

মাছ ছাড়াও পাঁঠা বলির মাংস ছিল পুজোর খাওন দাওনের অন্যতম আকর্ষণ। সেই সময়ে গ্রামাঞ্চলে মাংস কেটে বিক্রি হত না। তাই বলির পশুর মাংস খাওয়াই ছিল বচ্ছরকার দিনে একমাত্র মাংস খাওয়ার উপায়। ঢাকিরা ছিলেন বলি হওয়া পশুর চামড়ার দাবিদার। ঢাকের মেরামতি ও অন্যান্য কাজে এর ব্যবহার ছিল।

শুধু দুপুরের অন্ন ভোগ নয়। সন্ধের পর চাল ছাড়া রান্না করা মিষ্টি খাবার দিয়ে দেবীর পুজো করা হত। এই ‘বৈকালিক’ ভোগের অন্যতম পদ ছিল সুজি-ময়দার পাটিসাপটা, নারকোল দিয়ে সাদা মালপোয়া, ক্ষীর-ছানা, আটার পুলিপিঠা ইত্যাদি। বছরে একবার মেয়ে মায়ের কাছে এসেছে, তাই তার মন জোগাতে সাধ্যমত আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখা যাবে না। এছাড়াও সকালের বাল্যভোগে ফলের সাথে দেওয়া হত কাটা নারকোলের লাড়ু (নাড়ু), নারকোলের তক্তি (ছাঁচে ফেলা নারকোল চিনি / গুড়ের সন্দেশ), মোদক (গুড় চিনির পাকে তৈরি নৈবেদ্যের চূড়ায় বসানো মিষ্টি), তিলের নাড়ু, খইয়ের উপড়া (মুড়কি) ইত্যাদি। এসবের নেপথ্যে ছিলেন বাড়ির মেয়েরা। তাঁরা পুজোর আগের কয়েক মাসে এসবের যোগাড়যন্ত্র করে রাখতেন।

এভাবে সপ্তমী,অষ্টমী, নবমী জুড়ে ভাত, ডাল, খিচুড়ি, সবজি, মাছ, মাংস, মিষ্টি, পিঠা-পুলির শেষে নবমীর নিশি প্রভাত হয়ে বিজয়া দশমীতে কন্যারূপা দেবীর ঘরে যাওয়ার পালা। চালচুলোহীন, স্বভাব ভিখারি স্বামীর ঘরে সন্তানসমেত তিনি ফিরে যাবেন। অনেক দূরের সে পথ বেয়ে আবার মায়ের কাছে ফিরে আসবেন এক বছর পর আরেক শরতে। চোখের জলে তাঁকে বিদায় জানাবেন মা, আর পাতে দেবেন ‘গরীবের খাবার’, যা খেয়ে সাধারণ গ্রামবাসী আকালের দিনে কোনক্রমে বেঁচে থাকে।

আরো পড়ুন সর্বজনীন পুজোকে গ্রাস করছে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদ

বর্ষার শেষে পুকুর মাঠঘাটে ফুটে থাকা শাপলা, শালুকের দৃশ্য দেখে নাগরিক চোখ অবধারিতভাবে আবেগসূচক অব্যয়ের ব্যবহার করে। ‘এথনিক ফ্রিক’ শহুরে খাদ্যরসিকের কাছে এই ফুলের ডাঁটাও চিংড়ি সহযোগে দারুণ উপাদেয় ‘ডিশ’। কিন্তু এর বীজের দানা দিয়ে চাল, খইয়ের কথা কোনো শহুরে কাহিনি শোনায় না। বন্যায় ভেসে যাওয়া গ্রামে ঘরে চাল যখন বাড়ন্ত, ওই বীজের দানা রোদে শুকিয়ে, খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে ফুটিয়ে মূল খাবার হিসাবে খাওয়ার প্রচলন ছিল। ভাতের মত দেখতে বলে এর নাম ঢ্যাপের ভাত। একই দানা বালিতে ভেজে খইয়ের মত করে এখনো অনেক গ্রামে খাওয়া হয়। দুর্গাপুজোর শেষ দিনে দশমীতে দেবীর ভোগে এই ঢ্যাপের ভাত আর পাকা কলার বড়া ভোগে নিবেদন করা হত। ঘরে পড়ে থাকা বেশি পেকে যাওয়া কলা, আখের গুড় আর আটা-ময়দা দিয়ে এই বড়া ভেজে নেওয়া হত। না ছিল তখন উপকরণের বাহুল্য, না আর্থিক স্বাচ্ছল্যের বহিঃপ্রকাশ। আরাধ্য দেবীকে সমাবস্থানে দেখার সারল্যে নিতান্তই ঘরের জিনিস দিয়ে পুজো সাঙ্গ হত। হারিয়ে যাওয়া দেশগাঁয়ের এই দুর্গাপুজো শেষ হলে প্রতিমা বিসর্জন হত সূর্যাস্তের আগে গোধূলি লগ্নে। বাড়ির মেয়ে সন্ধে নামার আগে শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করবে, সে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে এক মুঠো চাল। বাড়ির কর্তা তার প্রতিনিধি হয়ে প্রতিমার উপর দিয়ে পেছনে ছড়িয়ে দেবেন এই অন্নমুঠি, আর গৃহবধূ আঁচল পেতে তা নেবেন – এই ছিল প্রথা। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর ঠাকুরঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ দিয়ে প্রবীণতম মানুষ ঘটে পূজার দ্রব্য ছুঁইয়ে শান্তিবচন পাঠ করবেন, শান্তিজল ছড়িয়ে দেবেন। তারপর পালা আমিত্তি (অমৃতি) দিয়ে মিষ্টিমুখ আর প্রীতি বিনিময়ের। চাষী, মাঝি, বানিয়া, পটুয়া, ঢাকি, পুরুত, শিক্ষক – সবাই জড়ো হতেন। মিলনোৎসবেই উৎসব শেষের শুরু আর দুর্গাপুজো করার সার্থকতা।

মঙ্গলকাব্য থেকে যে দেবীর পুজো শুরু, সেই দেবী ছিলেন অন্ত্যজ শ্রেণির আরাধ্য। চণ্ডীমঙ্গলের দুই খণ্ডের নাম আখেটিক খণ্ড ও বণিক খণ্ড। আখেটিক শব্দের অর্থ ব্যাধ। কালকেতু ও ধনপতি সওদাগরের আখ্যান যথাক্রমে শিকারী ও বণিকদের কাহিনি। সে যুগে সমাজে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য কমে গিয়ে বণিকরা প্রাধান্য লাভ করেছিল। বণিকদের মধ্যে এই পুজো প্রচলিত হলে তা সর্বজনীন হবে বলে মনে করা হত। তাই পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ, রাঢ়বঙ্গ সহ নানা অঞ্চলে এই কাব্যের পালাগানের বিভিন্ন পাঠ পাওয়া যায়। প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপন, ধর্মবিশ্বাস, ঈশ্বরের কল্পনা থেকে যে কথন-শ্রবণ কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের শুরু, কয়েক শতাব্দীব্যাপী ইতিহাসের নানা অভিঘাতে তার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ক্রমশ হারিয়ে যায়। বর্তমান দুর্গোৎসব বাজার অর্থনীতির জয়ঢাক মাত্র।

নিবন্ধকার পেশায় স্কুলশিক্ষিকা। বাংলার উৎসব, খাদ্যসংস্কৃতিতে আগ্রহী। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.