দেবাশিস সেনগুপ্ত
টানা আট বছর (১৯৭২-১৯৭৯) কলকাতা ময়দানের ‘দুই ভাই’ খেলেছেন একসাথে, এক দলে। পরে দুবছরের ব্যবধানে আরও একবছর (১৯৮২)। তাঁদের জুটি ভেঙে গিয়েছিল ১৯৮০ আর ১৯৮১ সালে। থ্রু পাস, হেড আর ভলিকে হাতিয়ার করে ১৯৭২-৭৯ এবং ১৯৮২ সালে বড় ভাই তাঁর স্কিল দিয়ে তৈরি অজস্র গোলের সুযোগ তুলে দিতেন ছোট ভাইয়ের পায়ে ও মাথায় আর গোল করে যেতেন ছোটজন। ১৯৭২-৭৪ – প্রথম তিন বছর লাল হলুদ জার্সি গায়ে ছিল তাঁদের। ১৯৭৫ সালে সাদা কালো জার্সিতে ঝলমল করেছেন। পরের তিনবছর – ১৯৭৬-৭৮, দুই ভাইয়ের গায়ে উঠেছিল সবুজ মেরুন জার্সি। ১৯৭৯ সালে ফের সাদাকালো জার্সি পরেছিলেন তাঁরা। ১৯৮২ সালে আবার লাল হলুদ জার্সিতে ফেরেন। ১৯৮০ সালে বড় ভাই ছিলেন ইস্টবেঙ্গলে আর ছোট ভাই ছিলেন মহমেডান স্পোর্টিংয়ে। ১৯৮১ সালে ছোট ভাই থেকে গিয়েছিলেন মহমেডানেই আর বড় ভাই গায়ে চড়িয়েছিলেন মোহনবাগানের জার্সি।
পিকের দেখা “সেরা খেলোয়াড়”, সুধীর কর্মকারের খেলা “টাফেস্ট ফরোয়ার্ড”, সুব্রত ভট্টাচার্যের উপলব্ধিতে “কড়া অভিভাবক”, গৌতম সরকারের মতে “বর্ন ফাইটার”, সুভাষ ভৌমিকের কথায় “পিকের চেয়েও বড় ফুটবল গুরু” আর আমার মত আম ফুটবলপ্রেমীর কাছে লড়াইয়ের প্রতিশব্দ ওই বড় ভাইয়ের নাম মহম্মদ হাবিব (ছোট ভাই আকবর)। কলকাতা ফুটবলের ইতিহাসে একটা বড় পরিচ্ছেদ লেখা থাকবে তাঁকে নিয়ে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আমার ফুটবল দেখার শুরু সাতের দশকে। ওটাই আমার ফুটবলে মহাষ্টমীর দশক, অঞ্জলি দেবার দশক। লড়াকু হাবিব ছিলেন সে পুজোর প্রধান পুরোহিত। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে ষষ্ঠ দশকে ঢুকে পড়েছে ফুটবল দেখার অভিজ্ঞতা। নিজের চোখে বহুবার দেখেছি বল কাড়ার জন্য প্রতিপক্ষের বুটের সামনে মাথা পেতে দেওয়া অকুতোভয় হাবিবকে। ভয় না পেয়ে ভয় পাওয়াতেন তিনি। এখনো জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে যে কোনো লোকের লড়াই দেখলেই আমার হাবিবকে মনে পড়ে।
কলকাতায় ১৭ বছর খেলেছেন, যার মধ্যে নবছর ইস্টবেঙ্গলে (১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮০, ১৯৮২), ছবছর মোহনবাগানে (১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৮১) আর দুবছর মহমেডানে (১৯৭৫, ১৯৭৯)। ভারতীয় ফুটবলে দুবার ত্রিমুকুট পাওয়া (১৯৭২, ১৯৭৭) হাবিব যখন যে ক্লাবের হয়ে খেলেছেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন কলকাতা ময়দানের চিরকালীন দশ নম্বর জার্সিধারী যোদ্ধা। দশবার করে কলকাতা লিগ আর আইএফএ শিল্ড, পাঁচবার ডুরান্ড কাপ, আটবার রোভার্স, তিনবার করে ফেডারেশন কাপ ও বরদলৈ ট্রফি, দুবার করে ডিসিএম ট্রফি, নাগজি ট্রফি এবং দার্জিলিং গোল্ড কাপ, একবার অমৃতবাজার শতবার্ষিকী ট্রফি জয়ী দলে ছিলেন হাবিব। নবছরে ইস্টবেঙ্গলকে দিয়েছেন ২৫টি ট্রফি আর তাঁর ছবছরে মোহনবাগান পেয়েছিল ২১টি ট্রফি। দুবছর মহমেডানে খেলার সময়ে অবশ্য কোনো খেতাব জেতেনি তাঁর দল।
ইতিহাস হয়ে গেছে বিদেশি দলগুলোর বিরুদ্ধে তাঁর খেলা। পাস ক্লাব (১৯৭০), পিয়ং ইয়ং (১৯৭৩), ডক রো গ্যাং (১৯৭৩), ক্রুকটাউন (১৯৭৬), কসমস (১৯৭৭), আরারাত (১৯৭৮), আরও কত। ১৯৭৭ সালে ইডেন উদ্যানে পেলের কসমস ক্লাবের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে সতীর্থরা যখন হামলে পড়েছেন ফুটবল সম্রাটের সঙ্গে ছবি তুলতে, তিনি বলেছিলেন “অ্যায়সা কিঁউ? উয়ো ভি প্লেয়ার, হাম ভি প্লেয়ার।” লোকগাথার মত এসব এখনো উড়ে বেড়ায় ময়দানের হাওয়ায় হাওয়ায়।
প্রাক্তন ফুটবলার সমরেশ চৌধুরী বলেছিলেন মাঠে নেমে “হারকে ঘৃণা করার শিক্ষক” ছিলেন মহম্মদ হাবিব। সুরজিৎ সেনগুপ্ত যাবতীয় লড়াইয়ের প্রেরণা হিসাবে মানতেন হাবিবকে। নিজের মায়ের সঙ্গে সঙ্গে “কড়া অভিভাবক” হাবিবকেও সুব্রত ভট্টাচার্য উৎসর্গ করেছেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী ষোলো আনা বাবলু। ময়দানের যোদ্ধা হাবিব ছিলেন লম্বা সময় ধরে কলকাতা ফুটবলের স্বর্ণযুগের চৌম্বক আকর্ষণ। রয়েড স্ট্রিটের মেসে সুব্রত ভট্টাচার্য, ভাই আকবরসহ জুনিয়রদের তাঁর আগলে রাখাও ইতিহাসে ঢুকে গেছে।
আরো পড়ুন জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত
২০১৮ সালে একটি দৈনিকে এক সাক্ষাৎকারে ১৯৭৯ সাল প্রসঙ্গে তিন প্রধানেই খেলা রক্ষণ বিভাগের প্রহরী মইদুল ইসলাম বলেছিলেন “হাবিবদা খুব শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন। মহমেডানের হয়ে প্রথম ম্যাচ। মাঠে নামার আগে আমার পেটে সমস্যা। সন্ধ্যায় খেলা। এদিকে প্রথম দলে আমার নাম রয়েছে। আমি হাবিবদার ঘরে গিয়ে সমস্যার কথা বললাম। হাবিবদার উত্তর ছিল, পেট খারাপে লোকে ভাল খেলে।”
এটাই হাবিবের প্রধান বৈশিষ্ট্য – হারকে ঘৃণা করা আর হার না মানা। কলকাতা ময়দানে তাঁকে ঘিরে যত প্রাচীন প্রবাদ উড়ে বেড়ায়, তাতে নিঃসন্দেহে তাঁকে বলা চলে অরণ্যদেব। থ্রু পাস, ট্যাকলিং, জোরালো শট, হেড আর ভলি যখন প্রাণপণ লড়াইয়ের সঙ্গে মিশে যেত, তার নাম হয়ে যেত হাবিব। ভারতের হয়ে খেলেছেন ১৯৭০ এশিয়ান গেমসে, জিতেছেন ব্রোঞ্জ পদক। ১৯৭০ মারডেকা কাপে তৃতীয় স্থান পাওয়া ভারতীয় দলেও ছিলেন। ১৯৮২ সালে পান অর্জুন পুরস্কার।
ময়দানের অরণ্যদেবেরও পারকিনসন্স আর অ্যালঝাইমার্স হয়েছিল ২০১৬ থেকে। তার মধ্যেও ২০১৯ সালে ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে আর ২০২১ সালে মোহনবাগান তাঁবুতে পিকে ব্যানার্জি-চুণী গোস্বামীর যৌথ স্মরণসভায় এসেছিলেন কলকাতায়। শেষদিকে ময়দানের কথাও আর মনে পড়ত না তাঁর। লড়াই করেও আর ফিরতে পারেননি সুস্থতার ট্র্যাকে।
ময়দানের হাজার তারার ভিড়েও টানা ১৭ বছর উজ্জ্বল থেকে যাওয়া ‘ফাইটার’ হাবিবের স্মৃতি চিরদিন আমাদের মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে। যতদিন কলকাতায় ফুটবল শব্দটা বেঁচে থাকবে, ততদিনই ফুটবল জনতার মনে থাকবে আদরের বড়ে মিঞাকে।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী, খেলা সম্পর্কিত একাধিক বইয়ের লেখক। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।