আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখন ষাটের দশক। বালিকার আরক্ত কপোল দেখে রক্তের পারদ ওঠানামা করে। আমরা যে সমস্ত ছবি দেখি বা ভাবি, সেসব বালিকা বধূ (১৯৬৭)-র মত সিনেমা। তখন আর সুচিত্রা সেন নায়িকা নন, তিনি অনেক পরিণত। বরং অপর্ণা সেনরা কড়া নাড়ছেন। অর্থাৎ সুচিত্রা আমাদের প্রজন্মের আইকন ছিলেন না। আমাদের দাদারা, অর্থাৎ পুরো পঞ্চাশের দশক এবং ষাটের দশকের প্রথম দিক, তাঁর মুগ্ধ প্রেমিক। এখন এটা ভাবলে ভাল লাগে যে সুচিত্রা বয়স এবং সময়ের দাবি অস্বীকার করে আমাদের স্বপ্নে মাঝে মাঝে পর্যটন করেন। তিনি আর নেই একথা ভাবলে আমাদের মনের গভীরে মেঘ জমে। আজ আমাদের মাথার চুল সাদা হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রণয় পর্ব এখনো শেষ হল না। আজ পর্যন্ত অধিকাংশ বাঙালি সুচিত্রার মুগ্ধ প্রণয়ী।
সুচিত্রাই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম নারী নীহারিকা। একথায় অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। পরিপ্রেক্ষিতে কানন দেবীর কথা আসতেই পারে। কিন্তু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে কানন দেবী যৌথ পরিবারের মধ্যে নারীরূপে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তা একান্তই সামন্ততান্ত্রিক জলবায়ুর ফসল। ১৯৩৮ সালে বিদ্যাপতি ছবিতে কানন দেবীর অনুরাধা টিপের যে আলোড়ন, তা দেখলে বোঝা যাবে সেখানে কানন দেবী মূল লক্ষ্যবস্তু নন। তিনি একটি ফ্যাশন বিবৃতি। কিন্তু সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে সুচিত্রা-উত্তমের প্রথম রোম্যান্টিক পরিসরের পরিচয়ে দেখা যায় সুচিত্রা নিজেকে স্বতন্ত্র নারী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। সেই সুচিত্রা কিন্তু তত সুন্দরী নন। তখনো তিনি মায়াবনবিহারিণী হয়ে ওঠেননি। সাড়ে চুয়াত্তরে একাধিক পুরুষের মেসবাড়িতে সুচিত্রার শরীরী গঠন আকর্ষণের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু নয়। তাঁর আহত ভ্রূবিলাস আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু বাঙালির স্বপ্নময় পরিবেশের স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা হয়ে ওঠেনি তখনো। তবু প্রশ্ন আসে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে – কে তুমি তন্দ্রাহরণী? আবার তিনি নিছকই পুরুষতন্ত্রের যাবতীয় শর্ত পূরণের যৌন উপাদান বা পুরুষের সহযোগী নন। আগেকার অভিনেত্রীরা ছিলেন পরিচালকের হাতে নটী এবং পুরুষ রাজত্বের একমাত্র উপকরণ। যদি আরেকটু তলিয়ে দেখি, তাহলে দেখব নক্ষত্রের নির্মাতাও কিন্তু পুরুষ। একজন পুরুষ অভিনেতা যদি নক্ষত্র হন, তবে তিনি স্বনির্ভর। তাঁর উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয় তিনি কী কী করতে পারেন বা কী কী করা সম্ভব। অন্যদিকে এতদিন নায়িকাকে নির্ভর করতে হত সমাজ নির্দেশিত মানচিত্রের উপরে। একজন নায়িকার গঠন সম্পূর্ণ হত না যদি না তিনি তাঁর বেশভূষা, তাঁর কণ্ঠস্বর, তাঁর রুচি থেকে বোঝাতে পারেন তিনি পুরুষের পৃথিবীতে কীভাবে ব্যবহারযোগ্যা। একজন পুরুষ মূলত দ্রষ্টা, একজন মহিলা মূলত দ্রষ্টব্য। সত্যি কথা বলতে কি, নারী দেখে যে তাকে সমাজ কীভাবে দেখছে। কানন দেবী ও অড্রে হেপবার্ন দুজনেই জানতেন, তাঁদের টিআরপি দাঁড়িয়ে আছে তাঁদের বিক্রয়মূল্যের উপরে। সেই বিক্রয়মূল্য লরা মালভের মত বিশিষ্ট তাত্ত্বিকের ভাষায় “to-be-looked-at-ness” – দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়ার যোগ্যতা। কারণ এই শরীরই পুরুষের আহ্লাদ, শরীরই একমাত্র বিনোদন, শরীরই একমাত্র ভ্রমণকেন্দ্র। “শরীর! শরীর! তোমার মন নাই, কুসুম?” পুতুলনাচের ইতিকথা তাহলে এই। নায়কের সঙ্গে নায়িকার প্রধান পার্থক্য হল নায়কের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ প্রতিশ্রুতি, নায়িকার সৌন্দর্যকে শুধু ব্যবহারের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে হয়। এইজন্যেই বলা হয়, চলচ্চিত্রে ‘men act, women appear’।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সুচিত্রার সিনেমা স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেতনা চোখ মেলল। প্রশ্ন এল পরতে পরতে – কে তুমি উৎস বিরহীতা উর্ব্বশী? “নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী”। যদি জনপ্রিয় ছবির আদলে ভাবি, তাহলে দেখব সমগ্র পঞ্চাশ এবং ষাট দশকে সুচিত্রা-উত্তম মেলোড্রামাতে সুচিত্রার মুখে যে অপরূপ রেখার কারুকার্য, তার উৎস বৈষ্ণব পদাবলী। “এলাইয়া বেণী, ফুলের গাঁথনি/দেখয়ে খসায়ে চুলি।/হসিত বয়ানে চাহে মেঘপানে/কী কহে দুহাত তুলি।” দেবকীকুমার বসু তাঁর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য (১৯৫৪) ছবিতে সুচিত্রার চিত্রণে মোটামুটি চণ্ডীদাসকেই অনুসরণ করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যে সুচিত্রার কেশবিন্যাস ঘোষণা করেছিল চল্লিশ দশকের সমাপ্তি এবং পঞ্চাশ দশকের সূচনা। বাঙালি নারীর চুলের সজ্জা তাকে লক্ষ করে বদলেছে। আর অজয় কর সুচিত্রাকে নিয়ে সফট ফোকাসে যেসব রেখাচিত্র আঁকেন, তাতে সুচিত্রার ইমেজ পূর্বরাগের সময়কার এবং কলহান্তরিতা রাধার অনুরূপ। তিনি আমাদের চেতনার গহনে ইশারা করেন। ফলে হলিউডের মায়া এড়িয়ে আমরা তাঁকে আমাদেরই মায়াকাননের ফুল হিসাবে চিনতে পারি। অজয় যে কী অনায়াসে বাঙালির নিজস্ব অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় খুঁজে পান সুচিত্রার মধ্যে! আমার তো মনে হয় অভিনয়-পটুতার চাইতেও আমাদের চেতনার উন্মোচনই সুচিত্রাকে অবিস্মরণীয়তা দেয়। সুচিত্রা তাঁর অভিনয় দিয়ে আমাদের পরাস্ত করেননি। তাঁর ভ্রূবিলাস যেন – ভ্রূ-পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে-র মতই। তাঁর অভিমানী ওষ্ঠাধর, আড়াআড়ি দৃষ্টিপাত দেখে মনে হয় তিনি যতটা দূরের ততটা কাছের নন। আবার মনে হয় কত কাছের, তবু কত দূরের। এই যে মায়ার টান, যেখান থেকে অড্রে হেপবার্নের মত তিনি প্রথম মৃত্তিকাবাসিনী হয়ে উঠলেন। তাঁকে ছোঁয়া যায় কিন্তু কুয়াশা তাঁকে আমাদের কাছে অপরিচয়ের করে রাখে অগ্নিপরীক্ষায়।
১৯৫৭ সালে অজয় কর এমন এক ভাষ্যকার, যিনি হারানো সুর ছবিটিতে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের একটি সাঁকো নির্মাণ করেন। কিন্তু হারানো সুর দেখার সময়ে আমাদের কারোরই মনে থাকেনি যে আসলে তা হলিউডের র্যান্ডম হার্ভেস্ট (১৯৪২) ছবিটির রূপান্তর।
বরং আমরা সবিস্ময়ে দেখি কালিদাসের হারানো আংটির পুনরুদ্ধার যেভাবে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলাকে মিলিত করে, হারানো সুর সেই বিচ্ছেদ ও মিলনের গল্পটি নতুন প্রসঙ্গে বলে। খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের শাসকরা তখনই বিবাহ ব্যবস্থাকে একটি আইনের আওতায় আনতে চাইছেন। সেই দ্বিধা এবং ঔৎসুক্য উত্তম-সুচিত্রার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল। আমাদের সমাজ সবসময় ভেবেছে যে মেয়েদের একটি আদর্শ মুহূর্তে মা হওয়া প্রয়োজন। সুচিত্রা সেই শর্ত পূরণ করেছেন। যেমন অসিত সেনের উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩) ছবিতে তিনি যুগপৎ জায়া ও জননীর ভূমিকাটিকে তুল্যমূল্য স্বীকৃতি দেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলিতে সুচিত্রা উত্তমকুমারের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছেন। হারানো সুরে সুচিত্রা দুর্ভাগ্যের মধ্যে দিয়ে পুরনো কিংবদন্তির মত প্রেমকে আবিষ্কার করেছেন। সুচিত্রা সংগ্রাম করে এবং কষ্ট সহ্য করে উত্তমকুমারের মধ্যে আপন অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিজস্ব প্রেমের পুনরাবিষ্কার করেছেন। সুচিত্রার এই সহিষ্ণু মনোভাবে একইসঙ্গে সুপ্তভাবে আমাদের প্রেমিকাকে মা হিসাবে দেখার প্রবণতার কথা মনে করায়। সুচিত্রা যখন ছবি বিশ্বাস প্রমুখ পিতার ভ্রূকুটি অস্বীকার করে উত্তমকুমারকে বিলেতে পাঠান এবং সেই উত্তমকুমার যখন বিলেত থেকে ফিরে আসেন, তখন সুচিত্রাকে আমাদের প্রণয়িনী মনে হলেও আদতে তিনি এক আশ্বাসবাক্য বা দেবদারু বৃক্ষ, অথবা এমন এক ছায়া পরিসর যেখানে আমরা সান্ত্বনা পেতে পারি। শুধু চুম্বন নয়। এই চুম্বন এবং সান্ত্বনার মধ্যবর্তী স্তর থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী ২০-২৫ বছর সুচিত্রাই আমাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন ঐতিহাসিক কারণে।
আরো পড়ুন ‘বাম বৃত্তে না থাকায় উত্তমকুমার বুদ্ধিজীবীদের অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন’
পঞ্চাশ দশকের সুচিত্রার ছবিতে পিতৃপ্রতিম অভিভাবকেরা হয় ভোলেভালা, নয়ত নেই। সুচিত্রা কেন উত্তমকুমারের সঙ্গে বাইকের পিছনে বসে অতটা জায়গা ঘুরবেন – এর জন্য তাঁকে কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি। এই স্বাধীন প্রবণতা আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আমরা নিজেরাও স্বপ্নে এরকম হতে চাইছিলাম। সেই স্বপ্নের একমাত্র চালিকা ছিলেন সুচিত্রা সেন। তিনি সমস্ত বাধানিষেধের ঊর্ধ্বে এমনই এক পরিসর, যেখানে মুহূর্তেই খুলে যায় স্বপ্নের স্বাধীনতা। স্বাধীনতালাভের পর আমাদের যে স্বাধিকারপ্রমত্তা তরুণীর দরকার হয়েছিল, তিনি সুচিত্রা সেন। তাঁকে আমরা প্রায়ই দর্পিতা ও অভিমানিনী – এই দুই ভূমিকায় যুগপৎ সচল দেখি। তাঁর আহার, ভ্রমণবিলাস আর তাঁর অপার স্বায়ত্তশাসন এবং কর্তৃত্বকে ছলনা করার ছলনা নিঃসন্দেহে একটি বিশিষ্ট প্রকাশভঙ্গিকে নির্দেশ করে। উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে আমাদের অন্তত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এক তন্বী নাগরিক যিনি নতুন আকাঙ্ক্ষাগুলিকে নতুনতর রং দিতে পারবেন। এ শুধু বাংলা ছবির ক্ষেত্রে নয়। আঁধি (১৯৭৫), দেবদাস (১৯৫৫), বম্বই কা বাবু (১৯৫৯)-র মত হিন্দি ছবি দেখলে বোঝা যাবে সুচিত্রা আশ্চর্যভাবে সেই স্বাধিকারের কথা বলেন।

এখনো দেখা যায় ৫০ পেরনো মহিলারা সুচিত্রাকে অনুসরণ করতে চাইছেন। এই যে ঘাড় বেঁকিয়ে কথা বলা, আপাতভাবে সবকিছুকে তুচ্ছ বলে প্রতিপন্ন করা – এসবই সুচিত্রার সাংস্কৃতিক হস্তাক্ষর। এটাই একজন তারকার বেঁচে থাকার শর্ত, যা মেরিলিন মনরো, মে ওয়েস্ট এবং অড্রে হেপবার্নের ছিল। তুলনামূলকভাবে মাধবী মুখোপাধ্যায় বা সুপ্রিয়া চৌধুরীর যা নেই।
নক্ষত্রের জীবনের আশেপাশে যে বিপর্যয়, অশ্রু ও কৌতূহল থাকে; আমাদের দেশেও একদা ওয়াহিদা রহমান, গুরু দত্ত বা রেখা, অমিতাভ বচ্চন সম্পর্কে খবরের কাগজ, ফ্যাশন পত্রিকা বা জনপ্রিয় উপন্যাস যে আগ্রহ দেখিয়েছিল; বিশেষ দেশ কাল পরিসীমার কারণেই বাংলা ছবিতে সুচিত্রা পরবর্তী যুগে বাংলা ছবিতে তারকাদের নিয়ে প্রচারের তেমন উগ্রতা দেখা যায়নি। আমাদের অপর্ণা, সুপ্রিয়া বা মাধবীর এমন কোনো গোপনীয়তা বা জীবনাতিরিক্ত বাগান নেই যেখানে হানা দিয়ে দর্শক নিজেকেই স্বাধীন মনে করতে পারেন। এঁরা অনেকেই গুণী অভিনেত্রী, কিন্তু বড় বেশি প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ। বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকারা এখনো প্রতিক্রিয়া, প্রায় ক্রিয়া নন। চারুলতা বা নীতা যে জীবন রচনা করে তার অনেকটাই সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটকের অবদান। তাই মাধবী, সুপ্রিয়ার অভিনয় পাড়ার দর্জির দোকান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের চর্চিত বিষয় নয়। কিন্তু যে যুবক কোনোদিন শ্রাবণে বা বৈশাখে স্তব্ধ প্রণয় মুহূর্ত খুঁজে পায়নি, গ্রামীণ সমাজ যাকে নির্জনতা দেয়নি, সে সুচিত্রার মধ্যে খুঁজে পায় সীমা ছাড়ানোর সীমা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে সুচিত্রা সেই দৃশ্যপ্রতিমারই জন্ম দেন যা জায়মান নাগরিকতার ছাড়পত্র। সমাজতাত্ত্বিক এদগার মোর্যাঁর সাহায্য নিয়ে বলা যায় “She incarnated a new elite. She proposes and imposes a new ethics of individuality which is that of modern leisure.” গীতা দত্ত যখন সুচিত্রার ঠোঁটে গেয়ে ওঠেন “কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার”, তখন বুঝতে পারি পঞ্চাশ দশকের রৌদ্রমুখর বাস্তবতার ফাঁকফোকরেও অনেক স্মৃতিবিধুর গীতিকাব্য লুকিয়ে থাকতে পারে।
সুচিত্রাকে আমার প্রায়ই বাঙালি ব্রিজিত বারদো মনে হয়। আমাদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে শরীরী সন্ত্রাস তত জরুরি নয় আর নগ্নতার সেই বেপরোয়া উচ্ছ্বাস বাদ দিলে সুচিত্রা চিরবালিকা, অবুঝ অভিভাবকের প্রত্যাশায় প্রেমার্ত।

সুচিত্রা-উত্তমের রোম্যান্টিক পরিসরগুলো শারীরিক আবেদনময় নয়। সুচিত্রা আমাদের পরাস্ত করেছেন তাঁর অভিমানী মুখভঙ্গি দিয়ে। অভিনয়ের আলো আঁধারি থেকে নক্ষত্রলোকে উত্তীর্ণ হতে সুচিত্রা যে পথ রচনা করেছিলেন সেখানে তিনি কোনোভাবেই প্রতিস্থাপনযোগ্য নন। সপ্তপদী (১৯৬১)-তে সুচিত্রার অভিনয় ব্যক্তির অতিরিক্ত এক সামাজিক সংলাপ। শাপমোচন (১৯৫৫)-এর সুচিত্রাকে দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি আর শহর থেকে প্রশ্ন করেছি মনে মনে “অয়ি পদ্মপলাশলোচনে তুমি কে?”
সত্তর দশকে সুচিত্রা যে সমস্ত ছবিতে অভিনয় করলেন সেখানে তাঁর স্বাধীন স্বতন্ত্র রোম্যান্টিক ইমেজের বদল ঘটল। নবরাগ (১৯৭১), ফরিয়াদ (১৯৭১) ইত্যাদি ছবিতে পাপের পথে একা নরকযাত্রী হিসাবে যে চরিত্রগুলি ভাবা হয়েছিল সেগুলিতে সুচিত্রা বিশেষ খাপ খান না। একথা সুচিত্রা আমাদের আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। সেই কারণেই এরপর তিনি আড়াল অবলম্বন করেন। তিনি বুঝেছিলেন জনতার পরিসরে বেশি দৃশ্যমান হলে তাঁর মায়া আবরণ ভেঙে যাবে। যেহেতু তিনি অন্তরালে, সেহেতু তাঁকে নিয়ে গুজব পল্লবিত হয়েছে। ক্রমাগত রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। এই রহস্যময়তা আর কোনো বাঙালি নায়িকাকে নিয়ে তৈরি হয়নি। সুচিত্রা জানতেন তাঁকে রক্তমাংসের কাঠামোয় নয়, সিনেমায় প্রাপ্ত কাঠামোয় বেঁচে থাকতে হবে। সেই কাঠামোকে যদি ছড়িয়ে দিতে হয়, তাহলে রক্তমাংসের অবয়বকে আড়ালে রাখতে হবে। বাঙালি মনস্তত্ত্বের আসল রহস্য সুচিত্রা ধরতে পেরেছিলেন এবং সেই রহস্যের স্তরে একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়িকা তিনিই।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।