sanjay mukhopadhyay

সিনেমাসহ সংস্কৃতির নানা ধারার পর্যবেক্ষক এবং আলোচক হিসাবে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় কোথায় দাঁড়িয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সচরাচর তাঁকে প্রশ্ন করা হয় ঋত্বিক ঘটক বা সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে। মহানায়কের মৃত্যুদিন উপলক্ষে নাগরিক ডট নেট ঠিক করেছিল উত্তমকুমার সম্পর্কে জমে থাকা কিছু প্রশ্ন রাখা হবে তাঁর সামনে। ফলে উঠে এল এমন অনেক কথা, যা হয়ত ক্লাসঘরের বাইরে খুব বেশি মানুষ তাঁর মুখ থেকে শোনেননি। নাগরিকের পক্ষে কথা বলেছেন প্রতীক

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সিনেমাকে যাঁরা শুধুই বিনোদন মনে করেন না, সিরিয়াস শিল্প বলে ধরেন, তাঁরা উত্তমকুমারকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রায়শই ছয়ের দশক থেকে তিনি যে ছবিগুলো করেছেন সেগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দেন। পাঁচের দশকের যে ছবিগুলো তাঁকে রোম্যান্টিক নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সেগুলোকে তেমন আমল দেন না। অনেকে এমনও বলেন যে তিনি কত বড় অভিনেতা তার প্রমাণ পাওয়া যায় নায়ক (১৯৬৬) ছবিতে এসে। এটা কি যথার্থ, নাকি এতে উত্তমকুমারের প্রতি কিছুটা অবিচার করা হয়?
আমার মনে হয় উত্তমকুমার শিল্পী হিসাবে, অভিনেতা হিসাবে আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলের থেকে চূড়ান্ত অবহেলা এবং অবিচার পেয়েছেন। উত্তমকুমার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত নায়ক এবং চিড়িয়াখানা (১৯৬৭) ছবিতে প্রচলিত অর্থে ভাল অভিনয় করেছিলেন বলে জাতে উঠেছেন – এরকম একটা ধারণা সত্যিই প্রচলিত আছে। কিন্তু এর থেকে বড় ভুল আর কিছু হয় না। উত্তমকুমার যখন ‘আবির্ভূত’ হন… আবির্ভূত বলছি এই কারণে, যে তাঁর প্রথম জনপ্রিয় ছবি… নির্মল দে পরিচালিত বসু পরিবার… যে ছবিতে তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন … সেটা মুক্তি পায় ১৯৫২ সালে। সে বছর আমাদের দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হল, ভারতীয়রা প্রথম গণতন্ত্রের স্বাদ পেল। মানে রাষ্ট্রপতি আর পাড়ার পাঁচু, দুজনেই একইভাবে ভোট দিতে পারল, দুজনের ভোটের মূল্যই সমান হয়ে গেল। সে বছরই উত্তমের প্রথম সাফল্য। এই সাফল্য সিনেমাতেও এক ধরনের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ছায়া ফেলেছিল, যার ফসল উত্তমকুমার। পরবর্তী সাফল্যও ওই বছরেই সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে, যদিও সেখানেও তুলসী চক্রবর্তী উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনকে প্রায় পার্শ্বচরিত্র করে দিয়েছেন। দুবছর পরেই মুক্তি পেল অগ্নি পরীক্ষা (১৯৫৪), এবং অবশেষে শাপমোচন (১৯৫৫)।

উত্তমকুমার ঠিক কে তা বোঝাতে গেলে অনেকরকম কথা উঠে আসবে। আজ যে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা উত্তমকুমারকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বা গুরুত্ব দেওয়ার ভান করছেন, তার কারণ তিনি আমাদের সাম্প্রতিক মিথোলজির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু সেই ছয়ের দশকেই তপন সিংহের গল্প হলেও সত্যি ছবিতে ফিল্ম সোসাইটির বুদ্ধিজীবী এবং বাঙালি ইগোকে প্রতিস্থাপিত করে উত্তমকুমারের উপকথা। এই ছবিতে উত্তমকুমার অভিনয় করেননি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অন্দরমহলে দুপুরের অবসরে হালকা সিনেমা পত্রিকা থেকে উত্তমচরিতমানস নির্মাণ করছেন দুই মহিলা। আর সেই বাড়িরই তরুণতম পুরুষটি ফিল্ম সোসাইটির প্রভাবে ত্রুফো আওড়াচ্ছেন। এই বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়েই উত্তম রহস্য সংস্কৃতির স্তর থেকে স্তরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

তপন সিংহ সাধারণ বাঙালি মহিলাদের মধ্যে উত্তমকুমারের এই যে জনপ্রিয়তা দেখিয়েছেন এটা কি সব বয়সের, সব এলাকার, সমাজের সব স্তরের মহিলাদের ক্ষেত্রেই সত্য?
একা তপন সিংহই যে ওরকম কল্পনা করেছেন তা নয়। অ্যান্ড্রু রবিনসন একবার সত্যজিৎ রায়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাঙালি মেয়েরা কোন অভিনেতাকে পছন্দ করে? সত্যজিৎ একটু কৌশল করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্সি কলেজের মেয়েরা হয়ত সৌমিত্রকে, বাকিরা উত্তমকে। এই কথাটার মধ্যে একটা দারুণ সত্য আছে। ছয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন যে মহিলারা, তাঁরা এলিট শ্রেণির প্রতিনিধি। তাঁরা সৌমিত্রকে পছন্দ করবেনই, কারণ তাঁর বিশুদ্ধ বাংলা ইংরেজি উচ্চারণ এবং আরও নানা কার্যকলাপের মধ্যে বুদ্ধিজীবীর যে আদলটা পাওয়া যায় সেটা তাঁদের মুগ্ধ করার মত। কিন্তু উত্তমকুমার সবসময়েই জনসাধারণের প্রতিনিধি।

আসলে যে কোনো চরিত্রই অতিকথার জন্ম দিতে পারে, যদি তা কোনো সন্দর্ভের প্ররোচনা পায়। উত্তমকুমার আমাদের সমাজে গল্পে, গুজবে, কেশবিন্যাসে, চালচলনে শুধু সজীবনী অভিনেতা (actor with a biography) নন। তিনি যে অতিকথার, মিথের জন্ম দিয়েছেন তা তাঁর অভিনয় প্রতিভার জন্য নয়, বরং সেই মুহূর্তগুলোর জন্য যা ওই অভিনয়কে বাস্তবায়িত করে। মনস্বী রোলাঁ বার্থ থাকলে বলতেন, মিথ এমন একটি বাচন যা ইতিহাস নির্বাচিত। কিংবদন্তীরও তো ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে।

মানে আপনি বলছেন উত্তমকুমার জনমানসে যে আসন পেয়েছেন তাতে তাঁর সময়টার ভূমিকা আছে?
হ্যাঁ। আসলে সুভাষচন্দ্র যে কারণে স্বাধীনতার পরে নেতাজি হয়ে গেলেন, উত্তমকুমারও প্রায় সে কারণেই মহানায়ক হয়ে গেলেন। দুজনেরই ইতিহাস থেকে অন্তর্ধানের সুযোগ ঘটেছিল। সত্যি কথা বলতে কি, তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার পরে সুভাষচন্দ্রের আর ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি করার কোনো দায় রইল না। সে কারণেই তিনি বিভাজনোত্তর দেশে, অন্তত পশ্চিমবাংলা এবং পাঞ্জাবে, যে কোনো অত্যাচার ও বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে সামরিক উর্দি পরিহিত নেতাজি হিসাবে দেখা দেন। তিনি আছেন, এই তো যথেষ্ট। সম্ভবামি যুগে যুগে। একইভাবে সাংস্কৃতিক কৌলীন্য না থাকাই উত্তমকুমারের ছাড়পত্র হয়ে উঠেছে এই একুশ শতকে। অর্থাৎ তিনি জনসাধারণের একজন, তিনি প্রান্তিক বলেই কেন্দ্রে আসতে পারেন।

এটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?
ধরো, শাপমোচনের নায়ক কলকাতায় এসেছে ১৯৫৫ সালে, যে বছর পথের পাঁচালী মুক্তি পায়। ভেবে দ্যাখো, অপরাজিত ছবির অপূর্বকুমার রায়ের মত সাংস্কৃতিক আভিজাত্য তার নেই। কিন্তু তারও সেই গ্রাম থেকে কলকাতায় আসা, এবং গ্রাম থেকে শহরে আসার এই উপাখ্যানে উত্তমকুমার অস্টারলিৎজ ফেরত নেপোলিয়নের মত সাধারণ দর্শকের মন লুঠ করে নেন। শহরের মধ্যে এক অলীক গ্রাম তৈরি হয় এবং উত্তমকুমার সেই নগরপল্লীতে লোকগাথার অবিসংবাদী সম্রাট হয়ে ওঠেন। সুতরাং যেসব বুদ্ধিজীবী আজও ভাবছেন অভিনয় শিল্প এমন একটা বিশেষ জিনিস যা কেবল তথাকথিত আর্ট সিনেমার জন্য সংরক্ষিত, তাঁরা টের পাননি যে তাঁদের তত্ত্ব মুখ থুবড়ে পড়েছে। এঁরা ভেবেছিলেন সত্যজিৎ, অংশত ঋত্বিক ঘটক আর কিছুটা মৃণাল সেনই পরিত্রাতা। এঁরা কোনোদিন নির্মল দে, অজয় কর, বিভূতি লাহা, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, তরুণ মজুমদার, তপন সিংহের মহিমা বুঝতে পারেননি। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কিছুক্ষণ ছবিটা যদি দ্যাখেন, দেখবেন রিল টাইম আর রিয়েল টাইম এক করে দেওয়ার চেষ্টা আছে, বাস্তবতার একটা অন্য রূপ খোঁজার কী অপরিসীম চেষ্টা রয়েছে! বুদ্ধিজীবীরা তো এসব খেয়ালই করেননি। এবং খেয়াল না করার পিছনে বামপন্থার গোপন প্ররোচনাও ছিল। উত্তমকুমার প্রসঙ্গেও এই একই উন্নাসিকতা কাজ করেছে।

যেমন তাঁর সম্পর্কে নাক সিঁটকে বলা হত, তিনি নাকি ভাল ইংরেজি বলতে পারেন না। আমি সম্যক জানি না উত্তমকুমার ইংরেজি কেমন বলতেন, কিন্তু একটা সদ্য স্বাধীন দেশে বাংলা ছবির একজন অভিনেতার ইংরেজি বলতে পারা বা না পারা কী কারণে দোষ বা গুণ হতে পারে তা আমার আজ অব্দি মাথায় ঢোকেনি।

তাহলে আপনি বলছেন শিল্পী উত্তমকুমারের আলোচনায় ওই রোম্যান্টিক ছবিগুলোকে স্রেফ হিট ছবি হিসাবে ভাবা, শিল্প হিসাবে গুরুত্ব না দেওয়ার পিছনে কোনো শৈল্পিক যুক্তি নেই?
ঠিক তাই। বরং আমি বলব ওই ছবিগুলোকে আমরা ঠিক করে পড়তেই পারিনি। যেমন শাপমোচনের উদাহরণ দিয়ে বলব, ওটা আসলে আমাদের গণতন্ত্রের শাপমুক্তির অতিকথা। ওখান থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের পক্ষে হয়ত সত্যিই সাবেকি ধর্মীয় সামন্ততন্ত্র পেরিয়ে একটা স্বাধীন গণতন্ত্রে পা রাখা সম্ভব। এখন পিটার ব্রুকসের দ্য মেলোড্রামাটিক ইম্যাজিনেশন পড়ার পর আমরা বুঝতে পারি, যে ব্যাপকার্থে ইতিহাসে যা ঘটে থাকে তাকে যদি অভ্যন্তরে নিয়ে আসা যায় তাহলে আবেগের কিছু অতিশয়োক্তি ঘটে। সে জিনিস পশ্চিম ভারতে ঘটিয়েছিলেন দিলীপকুমার, রাজ কাপুর এবং দেবানন্দ। আর পূর্ব ভারতে একা উত্তমকুমার – অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আমি হারবার্ট মারকিউসের কথা ধার করে বলব, উত্তমকুমার পাঁচের দশকে তাঁর অভিনয় দিয়ে ‘social sync’ হিসাবে কাজ করেছিলেন। ওই দশকের অশান্ত পশ্চিমবাংলায় তিনি সত্যিকারের নায়কের মত সংকটের পর সংকট পার হয়ে যাচ্ছিলেন।

উত্তমকুমার তো বিধান রায় নন। জ্যোতি বসুও নন। কিন্তু তাঁর ক্যারিশমা একের পর এক দুর্যোগ পার হয়ে যাচ্ছিল। উপরন্তু পাঁচের দশকের শেষ ভাগ এবং ছয়ের দশকের সামাজিক দোলাচলের দিকে তাকালে মনে হয়, ছবির পর্দায় এমন এক শান্তিনিকেতন তিনি গড়তে পারছিলেন যেখানে স্থিতাবস্থাই সত্য। আসলে তিনি কিন্তু স্ট্যাটাস কো-র পক্ষপাতী ছিলেন এবং তাঁর ছবির বাস্তবতা শাসকশ্রেণির মতাদর্শের বিপ্রতীপে অবস্থান করত না বলেই তিনি এত দীর্ঘকাল রাজত্ব করতে পেরেছেন। শাপমোচন, এন্টনি ফিরিঙ্গী, দেয়া নেয়া গানের বদলে প্রেমের আদর্শকেই তুলে ধরে। তাঁর গরীব চরিত্রগুলো নায়িকারা বড়লোক হওয়া সত্ত্বেও তাদের সাথে পুনর্মিলিত হয়। চালু মতাদর্শ উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রের উপস্থিতিতে কখনোই বিপন্ন বোধ করে না। ফলে যত তিনি বড় অভিনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, তত আর্ট সিনেমার উপেক্ষা বঞ্চনার সত্য হিসাবে জনসাধারণের হৃদয় মথিত করে। উত্তমকুমারের রাজ্যপাট নিরঙ্কুশ হয়।

তার মানে উত্তমকুমারের শিল্পী সত্তার যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না – এটা দর্শকরা বুঝতেন?
তিনি যে তাঁর প্রাপ্য পাচ্ছেন না এটা সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছিল। আজ বাংলার সংস্কৃতিতে বুদ্ধিজীবীদের যে নির্জীব অবস্থা, তার অন্যতম কারণ তাঁরা উত্তমকুমারকে ঠিক করে পড়তে পারেননি। উত্তমকুমারকে বাংলার মুখ বলা যদি অতিশয়োক্তিও হয়, তিনি নিঃসন্দেহে বাঙালিয়ানার এক ধরনের অভিজ্ঞান। যে আংটি দেখে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পেরেছিলেন, যে হারানো সুর দিয়ে ওই ছবিতে উত্তমকুমার শেষপর্যন্ত সুচিত্রাকে চিনে নেন, আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় বাঙালির সেরকম আংটি, সেরকম সুর নিশ্চিতভাবেই উত্তমকুমার। অথচ উত্তমকুমার বাঙালির মানসপটে এক ধরনের অনুপস্থিতির সত্য (truth of absence)। জীবদ্দশায় সংস্কৃতির নীল রক্ত তাঁর কপালে টীকা হয়ে দেখা দেয়নি। আপাতভাবে এই কারণেই ইতিহাস তাঁকে বারবার ফিরিয়ে আনছে এবং এখন এত দামি মনে করছে। যেন তিনি সত্যিই প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু। আসলে গরীবের ছেলের বঞ্চনার প্রতিকার মানুষ প্রত্যাশা করবেনই। বহু ছবিতেই উত্তমকুমার কাজ করেছেন এই প্রতিকার্য হিসাবে।

নায়ক ছবিটা তাহলে উত্তমকুমারের প্রতিভার পরিচয় নয়, বরং তার স্বীকৃতি?
নিঃসন্দেহে। সত্যজিৎ যে ম্যাটিনি আইডল হিসাবে উত্তমবাবুকেই বেছে নিয়েছিলেন, তার কারণ তিনি নির্বিকল্প। বস্তুত অরিন্দম চরিত্রের অন্য কোনো অভিনেতা থাকা সম্ভবই নয়। বাঙালি যে যে অভিলাষে নক্ষত্রদের কাছে হাত পাতে, উত্তমকুমার তার প্রায় সবকটা পূরণ করতে পারতেন। নায়কের নায়ক চরিত্রে অভিনয় বাঙালির সবচেয়ে প্রামাণ্য বাস্তব। সত্যজিৎ নিজে শিল্পী বলেই বুঝতেন, উত্তমকুমার যখন শিল্পী নন তখনো নায়ক এবং দিগন্তে ঈষৎ দূরে। যেন দেবদাস – আমাদের চেতনায় প্রায়শ্চিত্তের অপর বিন্দু। মদ, নারী কিম্বা নরক দেবদাস ও উত্তমকুমারের পা টলায় না। উপন্যাস, সিনেমা ও খবরের কাগজের পরপারে ওঁরা আমাদের জ্যান্ত রূপকথা। এই রূপকথা আমাদের আর কোনো নায়কই পূর্ণ করতে পারেননি। সৌমিত্রবাবু পারেননি, আর পরের নায়কদের আমি ধরছিই না। তাঁরা সবসময়েই শিক্ষিত, এক ধরনের রুচিস্নিগ্ধ মানুষের অভিনেতা হয়ে থেকেছেন। কিন্তু উত্তমবাবু যখন চোখ তুলে তাকিয়েছেন, তখন আপামর জনসাধারণ তার মধ্যে আত্মস্বীকৃতি খুঁজে পেয়েছে। এখানেই উত্তমকুমারের জয়।

এখানেই আমার পরের প্রশ্ন। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলা সিনেমার আলোচনায় একটা কথা খুব বলা হয়, যে গ্রামের দর্শক আর শহরের দর্শকের রুচি আলাদা। এমন কোনো ছবি বানানো মুশকিল যা দু জায়গার দর্শকেরই পছন্দ হবে। আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গ্রামের দর্শকের রুচিমাফিক বেশকিছু ছবি বানানো হত, যা শহুরে দর্শক পছন্দ করতেন না কিন্তু বক্স অফিসের পক্ষে ভাল ছিল। এখন আর সে ধরনের ছবি হয় না, ফলে বাংলা ছবি ভাল ব্যবসা করতে পারে না এবং সেই কারণেই ইন্ডাস্ট্রি ধুঁকছে। এটা যদি ঠিক হয়, তাহলে উত্তমকুমার গ্রাম, শহর নির্বিশেষে দর্শকের মন জয় করেছিলেন কী করে?
এই ধারণা ভুল। সত্যজিৎ রায় প্রশ্ন করতেন, কে বলেছে যে পথের পাঁচালী বেলঘরিয়া স্টেশনের ওপারে দেখা হবে না? আসলে আমরা আগে থাকতেই এরকম ভেবে নিয়েছি। একটা কথা বলি শোনো। বাংলার জনপ্রিয়তম ছবিগুলোর একটা হল গুপি গাইন বাঘা বাইন, আরেকটা হল পলাতক, আরও একটা মেঘে ঢাকা তারা। জলপাইগুড়ি, বালুরঘাট, বসিরহাট বা সুন্দরবনের বাঙালি এইসব ছবি দ্যাখেনি? কেন দেখল? সেখানকার স্কুল, কলেজে কি কেউ পড়ে না? বাংলা সাহিত্যের প্রচার এবং প্রসারই বা কোথায় হয়েছিল? বাংলা সাহিত্য মফস্বল শহরে, জেলায় জেলায় কেন তাহলে জনপ্রিয় হল? লাইব্রেরিগুলো কেন উপচে পড়ত বাঙালি লেখকদের বইতে? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো সে অর্থে শহুরে লেখক নন। সতীনাথ ভাদুড়ীও নন। তারও আগে শরৎচন্দ্রই তো গ্রাম, শহরের ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর লেখায়। গুগাবাবাও ভুলিয়ে দেয়। এটা যে পারে তার কারণ এই বইগুলো, এই ছবিগুলো এমন সব মানবিক অনুভূতিকে ছুঁয়ে ফ্যালে যেগুলোর গ্রাম-শহর বলে কিছু হয় না। শহর বলতে যদি শুধু কিছু ফ্লাইওভার, রাজারহাটের স্কাইলাইন আর দাম্পত্যের টানাপোড়েন – আমি যাকে হরমোন বিপর্যয় বলি – তাই দেখানো হয়, আর কবিতা বলতে দেখানো হয় জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি থেকে রক্ত পড়ছে, সেটা তো আর সিনেমা হয় না। কিন্তু ভেবে দ্যাখো, ভারতে যখন স্বাধীনতার পরে সদ্য হিন্দু বিবাহ আইন, স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে, তখন বাংলায় নরনারীর মিলন নিয়ে অগ্নি পরীক্ষা (১৯৫৪), হারানো সুর (১৯৫৭) হচ্ছে। এর কি কোনো গ্রাম-শহর আছে? পরবর্তীকালে যখন আমাদের সমাজে নরনারীর সম্পর্কে বদলে যাচ্ছে, চিড় ধরছে, তা নিয়ে সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), জতুগৃহ (১৯৬৪) হয়েছে। এসব ছবি তো গ্রামেও হিট হয়েছে। সুতরাং গ্রাম-শহর বিভাজন দিয়ে বাংলা ছবির ব্যর্থতার ব্যাখ্যা হল লোডশেডিং হত বলে বি এ পাস করতে পারিনি বলার মত। এসব যুক্তিকে ইতিহাস বা দর্শন সমর্থন করে না।

প্রযোজক উত্তমকুমার সম্পর্কে আপনার কী মতামত? ১৯৬৩ সালে দেয়া নেয়া-র মত বিশুদ্ধ রোম্যান্টিক ছবিতে নায়ক হলেন, অথচ প্রযোজনা করার সময় মানু সেনের হাসির ছবি ভ্রান্তিবিলাস আর অসিত সেনের প্রবল ব্যতিক্রমী উত্তর ফাল্গুনী। প্রথমটায় তবু ভরপুর বিনোদন আছে, রোম্যান্স আছে, উত্তমকুমার নিজে দুটো চরিত্রে অভিনয় করেছেন। দ্বিতীয়টা তো একেবারেই ছকভাঙা। পরের বছর জতুগৃহ। সেটা ছকের আরও বাইরে। সে ছবি শুধু প্রযোজনাই করলেন না, নিজে নায়কের চরিত্রে অভিনয়ও করলেন। এ তো বিরাট ঝুঁকি, তাই না? আবার ১৯৭৩ সালে নিজের নির্দেশনায় বনপলাশীর পদাবলী প্রযোজনা করলেন।
প্রথমত, এটাই প্রমাণ করে যে উত্তমকুমার বুদ্ধিজীবী নন এই ধারণাটাও ভুল। কারণ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তিনি যখন নিজে কী ছবি করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পাচ্ছেন তখন যে শিল্পরুচির পরিচয় দিচ্ছেন তা ছকে বাঁধা রুচির সঙ্গে মিলছে না। দ্বিতীয়ত, প্রযোজক উত্তমকুমারও একজন সফল মানুষ। বনপলাশীর পদাবলীকে আমি এই হিসাবের মধ্যে রাখছি না, কারণ ওটা একটা সমবায়ের মত ব্যাপার করে তৈরি। কিন্তু অসিত সেনকে দিয়ে উত্তর ফাল্গুনী করানো দারুণ সুবিবেচনার পরিচয়। এই ছবি হিন্দিতে এবং বাংলায় – দুটো ভাষাতেই অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল বিষয় মাহাত্ম্যে এবং অন্যান্য নৈপুণ্যের ফলে। এছাড়াও ওঁর নানা গুণ ছিল যেগুলো একজন সিনেমাশিল্পীর পক্ষে বিশেষ জরুরি। যেমন উনি ভাল গান গাইতে পারতেন, ফলে গানে লিপ দিতে জুড়ি ছিল না। এই গুণগুলোর কদর কিন্তু আমরা সমালোচকরা একসময় করিনি।

আরো পড়ুন দিলীপ কুমার: বোম্বে টকিজের শেষ প্রতিনিধি

কেন বলুন তো?
আসলে উত্তমকুমার কোনোদিন প্রতিবাদী বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। আর ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের উদয়ের পরে পারফর্মিং আর্টের প্রায় সব নামকরা শিল্পীই সেই মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কোনো না কোনো সময়ে। কিন্তু উত্তমকুমার একেবারেই পা বাড়াননি। ফলে আমাদের মধ্যে উত্তমকুমার সম্পর্কে এক ধরনের অবজ্ঞা তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আরেকটা দোষ ছিল। পোর্ট ট্রাস্টের একজন সামান্য কেরানি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতির একজন মহীরুহ হয়ে উঠবেন – এটা তুলসী চক্রবর্তীর বেলাতেও তাঁরা অনুমোদন করেননি, উত্তমকুমারের বেলাতেও যতদিন পারেন অস্বীকার করে গেছেন। এখন সত্যজিৎ রায় নামক তুলসীপাতা দিয়ে শুদ্ধ করে নিয়ে ঘরে তুলছেন। এটা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হাজারটা ব্যর্থতার মধ্যে একটা। আমরা প্রকৃতপক্ষে সিনেমার থেকে বহু মাইল দূরে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক মতবাদ দিয়ে উত্তমকুমারকে পড়তে গেছিলাম। আমরা ভুলে গেছিলাম, যে ত্রুফো আলফ্রেড হিচককের একটা অত ভাল এবং অত বড় সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই হিচকক যিনি বাণিজ্যিক ছবির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ছিলেন। কারণ হিচকক, জন ফোর্ড, উইলিয়াম ওয়াইলারদের ফরাসী নবতরঙ্গ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিল তার কার্যকারণ বাঙালি চিন্তাবিদরা বুঝতে পারেননি। এই কারণেই মেরিলিন মনরোকে নিয়ে পাসোলিনির মত চলচ্চিত্রকার কবিতা লেখেন। এলভিস প্রেসলি বা পপ গান নিয়ে গবেষণা হয় আর এম এ পাস বাঙালি বুদ্ধিজীবী হিন্দু বিধবার মত হেঁশেল আমিষ না নিরামিষ তার খোঁজ করেন। অতএব উত্তমকুমার তাঁর সময়ে গুরুত্ব পান না।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

2 মন্তব্য

  1. এই এতবড় লেখাটির কী সার্থকতা? এমন কথা কোথাও লেখা আছে যা আমরা জানি না? যদুবংশের উল্লেখ তো দেখি নি। বামেরা উত্তমের প্রতি মনেযোগী ছিলেন না এটা একটা প্রধান মত তোলা হয়েছে। উত্তম কুমারের শিল্পী সংসদ অভিনেত্রীসংঘের বিপরীতে ছিল এ তো জানতাম। বামেরা উত্তমের বিরুদ্ধে ছিল বা পছন্দ করে নি তারকি কোন ডকুমেন্ট আছে? মৃত্যুর পর রবীন্দ্রসদনে আনার ব্যাপারে পুরো কার্যকারণ জানবেন । হেমন্তও ঠিক বামপন্থীদের পক্ষে ছিলেন বলে শুনি নি অন্তত শেষ দিকে কিন্তু মৃত্যুতে রবীন্দ্রসদনে আনার পর জ্যোতিবাবু নিজের হাতে মালা দেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন দেখেছি। উদ্দেশ্যপূর্ণ পোস্ট না করা উচিত

  2. দুটি কথা বলার আছে। প্রথমতঃ আপনি বলছেন, “এমন কথা কোথাও লেখা আছে যা আমরা জানি না?” তথ্য হয়তো আমরা অনেকটাই জানি, কিন্তু তার উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আমাদের সত্যিই অজানা। দ্বিতীয়তঃ “উদ্দেশ্যপূর্ণ পোস্ট না করা উচিত” এই বলে আপনি আসলে যা বোঝাতে চেয়েছেন, তাতে মনে আপনি এটাই বুঝতে পারেননি যে এটি কোনো প্রবন্ধ না, বরং সাক্ষাৎকার। আর, যার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, তিনি কোনো বিরূপ মন্তব্য করলেও, তা যদি অশ্লীল না হয়, তবে তা অবিকৃতভাবে প্রকাশ করাই সাক্ষাৎপ্রার্থী সাংবাদিকের ধর্ম। এই সাক্ষাৎকারে সঞ্জয়বাবু তাঁর মত প্রকাশ করেছেন। আপনি সেই মত নাই মানতে পারেন, তথ্য দিয়ে তার বিরোধিতাও করতে পারেন, কিন্তু কোনো সাক্ষাৎকারকে বিকৃত করার কথা বলতে পারেন না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.