“উই ন্যু দ্য ওয়ার্ল্ড উড নট বি দ্য সেম।”

একটা সফল পরমাণু পরীক্ষা শেষে, উপস্থিত সকলের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, উন্মাদনার সামনে প্রায় স্বগতোক্তির মত এই কথা আওড়াচ্ছিলেন এক বিজ্ঞানী। তার ভিতরেও উল্লাসে ফেটে পড়ছে হল। মনে হচ্ছে ওপ্পি (ওপেনহাইমারের ডাক নাম) এই তো একেবারে সামনে চলে এসেছেন। সহসা মনে পড়ে গেল, কিছুক্ষণ আগেই দেখতে বসেছি ক্রিস্টোফার নোলানের ছবি। দেখতে দেখতে কখন যে মগ্ন হয়ে গেছি সে খেয়াল নেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

২১ জুলাই মুক্তি পেয়েছে নোলানের সৃষ্টি ওপেনহাইমার। কী গল্প বলেছেন নোলান ১৮২ মিনিট ধরে? পরমাণু বোমা বানানোর গল্প? হলে ঢোকার সময়ে দেখলাম সেখানকার একজন কর্মচারী হাঁকছেন “অ্যাটম বোম এদিকে, ওয়ে অ্যাটম বোম এদিকে”। না, বোমা বানানোর গল্প এ নয়। কাই বার্ড ও মার্টিন জে শেরউইন রচিত পুলিৎজ়ার পুরস্কার পাওয়া জীবনীমূলক গ্রন্থ আমেরিকান প্রমিথিউস: দ্য ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি অফ জে রবার্ট ওপেনহাইমার এই ছবির মূল উপাদান। ২০০৫ সালে প্রকাশিত বিশ্ববিশ্রুত আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের বিশ্লেষণধর্মী জীবনগাথা এটি।

পরমাণু বোমা নির্মাণের পুরোধার পর্বতসম যশ, খ্যাতি আর সেইসঙ্গে চূড়ান্ত অসম্মান ও হেনস্থায় গাঁথা এই ছবি। একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর প্রায় ৩০ বছরের উত্থান পতন তুলে ধরেছেন নোলান তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায়। অন্যবারের মত এবারও সাফল্যের সঙ্গে উতরে গেছেন তিনি।

পর্দায় ওপ্পিকে জীবন্ত করে তুলেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা সিলিয়ান মার্ফি। রবার্ট ডাউনি জুনিয়র (স্ট্রস )থেকে শুরু করে ম্যাট ডেমন (গ্রোভস), এমিলি ব্লান্ট (কিটি ওপেনহাইমার), টম কন্টি (আইনস্টাইন) – একেবারে চাঁদের হাট বসেছে এই ছবিতে। পর্দায় যখন একে একে আইনস্টাইন, ফার্মি, ফাইনম্যান – একঝাঁক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছিল, মনে হল টাইম মেশিনে চেপে হাজির হয়েছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। চারপাশে প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীদের আনাগোনা। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় অজান্তেই উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। সবচেয়ে মজার কথা, ইন্টারস্টেলার ছবির পরিচালকের মেধার আয়নায় ফুটে উঠেছে এমন একটা সময় যখন আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান তৈরি হচ্ছে। ঘটনাগুলো এক থাকলেও বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বদলে যাচ্ছে সেগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, পাল্টাচ্ছে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি।

ওপেনহাইমারকে বলা হয়েছে ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’। প্রমিথিউস কেন? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এগোবার আগে আমরা বরং একটু পরিচিত হই ওপ্পির সাথে। কেন এত জনপ্রিয় ওপ্পি? তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি, তাঁর ছাত্ররা পেয়েছেন। কিন্তু তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন একগুচ্ছ নোবেলজয়ীকে। স্নাতক হওয়ার পর পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকেছিলেন ওপ্পি। কিন্তু ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে থমসন ও রাদারফোর্ডের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করার পর বুঝলেন ওটা তাঁর জায়গা নয়। ল্যাবে কাজ করাকালীন একসময় নীলস বোরের প্রশ্ন ধেয়ে এল “বীজগণিতের সঙ্গীত শুনতে পাও?.. তাহলে গেটিংগেন চলে যাও”। সেই সময়ে জার্মানির ম্যাক্স বর্নের ডাকে গেটিংগেন পাড়ি দেন ওপ্পি। গেটিংগেন তখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আঁতুড়ঘর। আইনস্টাইনের দুই আপেক্ষিকতার আঁচ তখনো বেশ গনগনে। চারপাশে তখন ডিরাক, পাওলি, হাইজেনবার্গের মত তারকা বিজ্ঞানী, যাঁরা হয় ইতিমধ্যেই নোবেল পেয়েছেন, না হলে দু-এক বছরের মধ্যেই পাবেন। এই সময় কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় সাড়া জাগানো কাজ করেন ওপ্পি, সঙ্গে গুরু বর্ন। একই সময়ে প্রকাশিত হয় তাঁদের সাড়া জাগানো কাজ ‘বর্ন-ওপেনহাইমার অ্যাপ্রক্সিমেশন’, যা গোটা দুনিয়ার পদার্থবিদ্যার স্নাতক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্য। এরকম অনুকূল তাত্ত্বিক পরিবেশে ১৯২৭ সালে ডক্টরেট হন ওপ্পি। এরপর ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে একইসঙ্গে বার্কলে এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়ানো শুরু করেন তিনি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পাশাপাশি ডিরাক প্রবর্তিত রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, ইউকাওয়ার মেসন তত্ত্ব – কোথায় মাথা ঘামাননি? তিনের দশকের শেষদিকে নিউট্রন স্টার এবং ব্ল্যাক হোল যখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, সেইসময় (১৯৩৯ সালে) ‘অন মাস অফ নিউট্রন স্টার’ নামে ভকহফের সঙ্গে একটা পেপার প্রকাশ করেন তিনি, যার মেট্রিকগুলো নিয়ে পরে পর্যালোচনা করেন টলম্যান। প্রকাশিত হয় বিখ্যাত টি ও ভি (টলম্যান, ওপেনহাইমার, ভকহফ) সমীকরণ। সে বছরই প্রবাদপ্রতিম বোর এবং জন আর্চিবল্ড হুইলার ফিজিকাল রিভিউ জার্নালে প্রকাশ করেছেন দ্য মেকানিজম অফ নিউক্লিয়ার ফিশন, যার বিষয় পরমাণু বোমা বানানোর মূল নীতি। কিন্তু নিয়তির পরিহাস এই যে হুইলার পরবর্তীকালে হয়ে যান বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী, আর হুইলারের কাজে প্রভাবিত ওপেনহাইমার হয়ে গেলেন পরমাণু বোমার জনক।

ওপ্পি বিখ্যাত তাঁর মনোমুগ্ধকর পড়ানোর জন্যে, বিপুল আলোচিত তাঁর পরিষ্কার মতপ্রকাশের জন্য, এমনকি গ্রোভস ও স্ট্রসের মতো সরকারি কর্তাদের সামনেও, যা আজকের যুগে বিরল। না, নিছক একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর জীবনী নোলান বানাননি। গল্প এগিয়েছে একটা বিচারসভার পাল্লায় ভর করে। ওপ্পির বিচার। রাষ্ট্রকে পরমাণু শক্তিধর বানিয়েও বিজ্ঞানীর আনুগত্যের বিচার। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের দায়িত্ব পাওয়ার আগে থেকেই তাঁর প্রেমিকা ট্যাটলক (ফ্লোরেন্স পিউ) কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাঁর ভাই ফ্রাঙ্ক এবং তার প্রেমিকাও বাম ঘেঁষা। এসব কথা এফবিআই গোড়া থেকেই জানত। এর পরেও সাইক্লোট্রনের উদ্ভাবক লরেন্সকে না নিয়ে ওপেনহাইমারকে বেছেছিলেন কর্নেল গ্রোভ। রাষ্ট্র ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে আরেকটা অভিযোগ এনেছিল। তিনি নাকি পরমাণু বোমা তৈরির সময়ে হাইড্রোজেন বোমার ব্যাপারেও সমান আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মত বদল করেন। কেন করেন?

প্রশ্ন, যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, কথার মারপ্যাঁচ – এইসব নিয়ে সাধারণ আদালত নয়, এক বিশেষভাবে গঠিত বোর্ডের সামনে চলছিল এই বিচার। আর ওপ্পি বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন অতীতে, ম্যানহাটনের দিনগুলোয়। অনেক বিষয়ে দ্বিধা ছিল ওপেনহাইমারের। যতই তিনি ‘ফাদার অফ অ্যাটম বম্ব’ হোন না কেন, দু লক্ষ লোকের মৃত্যুর জন্য তিনিই তো দায়ী। হিরোশিমা, নাগাসাকিকে তো তিনিই বেছেছিলেন বোম ফেলার জন্যে। তাই রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে যখন তিনি বলছেন “আমার হাতে এত মানুষের রক্ত লেগে আছে…”, নিষ্ঠুর রাষ্ট্রপতি তখন হেসে এগিয়ে দিচ্ছেন রুমাল।

আরো পড়ুন সত্যজিৎ রায় মানুষটা আর তাঁর ছবি একে অপরের পরিপূরক: ব্রান্ডো

প্রায় এক দশক টালমাটাল অবস্থা চলে ওপ্পির জীবনে। পরে জন এফ কেনেডি ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। কেনেডি তাঁকে বিখ্যাত এনরিকো ফার্মি পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন। আততায়ীর হাতে কেনেডির হঠাৎ মৃত্যুর পর লেডি কেনেডি এবং পরবর্তী রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসন হোয়াইট হাউসে ওপেনহাইমারের হাতে সেই পদক তুলে দেন। কিন্তু বাহ্যিকভাবে মুক্ত হলেও ওপেনহাইমার মানসিকভাবে কখনো মুক্ত হতে পারেননি। আজীবন তিনটে মৃত্যু তাড়া করে বেড়িয়েছে তাঁকে – হিরোশিমা, নাগাসাকি আর তাঁর প্রথম প্রেমিকা ট্যাটলকের মৃত্যু। কথা বলার চেষ্টা করেও কথা বলতে পারেননি অনেক সময়। তাঁর মনের ভিতরের অস্থিরতা, রাগ, দুঃখ ও হতাশা অনবদ্য ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালকের প্রিয়পাত্র মার্ফি। স্ট্রসের চরিত্রে রবার্ট ডাউনি জুনিয়রও অনবদ্য। পর্দায় তাঁর এবং ওপ্পির ঠান্ডা দ্বৈরথ উপভোগ্য।

গ্রীক পুরাণ অনুসারে স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে নশ্বর মানবজাতিকে উপহার দিয়েছিলেন প্রমিথিউস। তিনি পৃথিবীতে এনেছিলেন জ্ঞানের মশাল। এজন্য অনন্তকাল নির্বাসন ভোগ করতে হয় তাঁকে। ওপেনহাইমার বুঝেছিলেন যে কাজ তিনি শুরু করে গেলেন তা থামবার নয়। জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করানোর জন্য যে পরমাণু শক্তির উদ্ভব, কালের নিয়মে সে একদিন গ্রাস করবে গোটা মানবসভ্যতাকে। তাই ওপেনহাইমার প্রমিথিউস। আরও একটা তিক্ত সত্য তুলে ধরেছেন নোলান। সফলতার মুখ না দেখা অব্দি বিজ্ঞান বিজ্ঞানীদের সম্পদ। একবার আবিষ্কার হয়ে গেলে তা চলে যায় রাষ্ট্রের জিম্মায়। সেকথা ফুটে ওঠে ট্রুম্যানের আস্ফালনে “ তুমি বোমা বানালেও, দুনিয়া জানবে আমি বোমা ফেলেছি।”

এ ছবির সিনেমাটোগ্রাফিতে সম্পূর্ণ নোলানের ছাপ। আধুনিক সিজিআই সরিয়ে রেখে শুধু ক্যামেরায় ধরেছেন ট্রিনিটি বিস্ফোরণের দৃশ্য। হঠাৎ নিশ্ছিদ্র নীরবতা, আগুনের লেলিহান শিখা খেলা করে বেড়াচ্ছে গোটা পর্দা জুড়ে, তারপর মেদিনী বিদীর্ণ করা আওয়াজ। ওপেনহাইমার বিড়বিড় করে বলছেন “নাও আই অ্যাম বিকাম ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড”। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কারসাজি ছাড়া এ দৃশ্য দেখাতে কেবল নোলানই পারেন। প্রায় ৩০ বছরের বৈজ্ঞানিক, সামরিক ও রাজনৈতিক তথ্যবহুল গল্প তুলে ধরেছেন নোলান। ওপ্পির মন খারাপ পরিচালক বেঁধেছেন সঙ্গীতের জালে। তাই হলের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কানে বাজে লুদউইগ গোরানসনের সুর। পা ঈষৎ অবশ, বারবার ভেসে ওঠে মার্ফির করুণ মুখ। এই রেশ থাকবে বেশ কিছুক্ষণ।

§ মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. নিপীড়ন-শোষণভিত্তিক ব্যবস্থার মধ্যে বিবেক নিয়ে বেঁচে থাকার যে কি বিড়ম্বনা, তা এই ছবিতে খুব চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.