দক্ষিণবঙ্গে অসময়ের বৃষ্টিতে আবার ক্ষতির মুখে ক্ষেতের ফসল। ঘূর্ণিঝড় না হলেও, প্রবল বর্ষণে ক্ষেতে জল জমেছে। কোথাও ক্ষতি হয়েছে ধান বা সব্জির। কোথাও আবার সবে বসানো আলু নষ্ট হয়ে গেছে। রীতি মেনেই ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। সরকার চাইবে ক্ষতি কম করে দেখাতে আর কৃষকের অভিজ্ঞতা বলবে অন্য কথা। সরকারের দাবি, কৃষকদের সহায়তায় নানা প্রকল্প আছে। রয়েছে শস্যবীমা, রয়েছে নানা উপকরণ দেওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে কজন সেসব সুযোগ পান?

কেন্দ্র-রাজ্য তরজায় মনে হবে, তাদের মধ্যে কৃষক সেবার প্রতিযোগিতা চলেছে। সরকারি বন্দোবস্তের শেষ নেই। তেমনই কৃষক আত্মহত্যারও শেষ নেই। এই বাস্তবতা বুঝতে না পারলে আমাদের সামনে এক ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে। বাজারে খাদ্যদ্রব্যের অগ্নিমূল্য তারই আভাস দিচ্ছে। এবারের প্রবল বর্ষণে শুধু যে শীতের সব্জি নষ্ট হল তা-ই নয়। ধানের, আলুর ফলনে ব্যাপক ঘাটতি হলে অদূর ভবিষ্যতে পরিণাম ভয়ঙ্কর। নাগরিক জীবনেও সেই ছোঁয়াচ লাগতে বাধ্য।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কথায় আছে আশায় বাঁচে চাষা। এক মরসুমে লোকসান হলে পরের মরসুমে লাভের আশা। এক ফসলে লোকসান, অন্য ফসলে পুষিয়ে নেওয়ার আশাতেই তাঁরা বাঁচেন, তাঁদের বাঁচতে হয়। কিন্তু লোকসানের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি না পেলে? মিডিয়া জানাচ্ছে আলু ক্ষেতে বৃষ্টির জমা জল সরানো নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার পর স্বামী কিটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ধার করে আলু বসিয়ে বৃষ্টিতে ক্ষতিই তাঁকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে। হলফ করে বলা যায়, দেনার দায়ে কৃষক আত্মহত্যার কথা সরকার স্বীকার করবে না। বলবে সাংসারিক অশান্তিতে মৃত্যু। দিন কয়েক আগেই এক কৃষক দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন। মিডিয়া জানাচ্ছে মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানি থেকে তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। কৃষকদের জন্য সরকারের এত বন্দোবস্ত থাকলে এমন হচ্ছে কেন? ফসল ফলিয়ে লোকসানটাই যেন এখন দস্তুর। গত বছর থেকে লকডাউনে ফসলের দাম মেলেনি। বীজ, সারের কালোবাজারিতে বেড়েছে খরচ। তারই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় আর ঘন ঘন নিম্নচাপের আক্রমণ।

গত বছর এই সময়ে আলুবীজের দাম বস্তায় ৫০০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল ( ৫০ কেজিতে এক বস্তা)। এই বছরের শুরুতে সেই আলু কৃষক ব্যাপক লোকসান করে বেচতে বাধ্য হন। সরকার অনেক পরে এমএসপি ঘোষণা করে। কিন্তু সেটা চাষের খরচের থেকে অনেকটাই কম। তাও সরকার নয়, সেই দামে কোল্ড স্টোরেজগুলো কিনবে। সরকার এভাবেই ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কৃষককে লোকসান করতে বাধ্য করে। অথচ সরকারি প্রচারে মনে হবে, তারা কতই না কৃষক দরদী। আলু তোলার পর ছিল অন্য ফসলের চাষ। নিম্নচাপে সেসব ফসলেরও অনেকখানি ক্ষতি হয়েছে।

তারপর ধান রোয়ার সময়ে আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়। নিম্ন দামোদর উপত্যকায় এক মাসের মধ্যে দুবার বন্যা হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের কোথাও কোথাও আবার এ বছরে তিনবার বন্যা হয়ে গেছে। আলু চাষের ক্ষতি ধান চাষে পুষিয়ে নেওয়ার আশা শেষ। অনেককেই বন্যার জন্য দ্বিতীয়বার ধান রুইতে হয়েছিল। তাই এখনও অনেকেরই ধান কাটা হয়ে ওঠেনি। আবার কাটা হলেও অনেকের ধান মাঠেই পড়েছিল। এবারের নিম্নচাপে সেই ধান নষ্ট হল। প্রকৃতির মার একেই বলে।

ধান যারা তুলতে পেরেছিলেন, তাঁরাও কি লাভের মুখ দেখেছেন? এবছরে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এম এস পি) বেড়ে হয়েছে কুইন্টাল প্রতি ১৯৪০ টাকা। সরকার কৃষকদের থেকে ধান কেনার বন্দোবস্ত করেছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক কৃষককেই তার থেকেও কম দামে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। অনেকেই কুইন্টাল প্রতি ১৫০০ টাকারও কম দরে বিক্রিতে বাধ্য হয়েছেন। অঞ্চল বিশেষে দামের ফারাক থাকলেও, এমএসপির থেকে কম দামে বেচার চিত্রটা সর্বত্র প্রায় এক। সরকার যদি সরাসরি ধান কেনার সুবন্দোবস্তই করে, তাহলে কম দামে কৃষকদের ধান বেচতে হয় কেন? আসলে গলদটা বিসমিল্লায়। বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু সেটা সুবন্দোবস্ত নয়।

ধান কেনার কেন্দ্র দূরে হলে ফসল নিয়ে যাওয়ার সমস্যা আছে। কুইন্টাল পিছু কিছু ধান বাদ যায়। টোকেন পেতেও নানা হুজ্জত। কিছু লোক বস্তা বস্তা ধান সরকারি কেন্দ্রে বিক্রি করতে নিয়ে যায়, অনেককেই অপেক্ষা করতে হয়। এসব নিয়ে সক্রিয় থাকে ফড়ে ও দালালদের চক্র। সরকারের কাছে ধান বেচতে রয়েছে নিয়মের হাজার একটা গ্যাঁড়াকল। সবদিক সামলাতে পারলেও দাম কবে পাবেন, তার অনিশ্চয়তা। ছোট চাষি বা ভাগচাষির এত হুজ্জত পোহানোর সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নগদ পয়সা হাতে পেতে হবে। কারণ পরের ফসল ফলাতে হবে। তাই কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

এবার শীতের সবজি বা আলু চাষের পালা। আশা ছিল আগের লোকসান এবার পুষিয়ে যাবে। তাতেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপদ। ধান ঠিক সময়ে তুলে যাঁরা আলু বসিয়েছিলেন, তাঁদের খরচও কম হয়নি। বেশিরভাগ জমিতেই আলু বসানো হয়ে গেছে। আলুবীজের দাম গত বছরের থেকে এ বছর কম। আলুর রকম ও এলাকাভেদে মোটের ওপর, বস্তাপিছু ২০০০-৩০০০ টাকা। কিন্তু সার নিয়ে কালোবাজারি হয়েছে। সরকারের থেকে সবাই যদি ঠিকমত এসব পেতেন, তাহলে কালোবাজারি হল কেন? অনেক পরে সরকারের টনক নড়ল। কিছু অভিযানও হল। কৃষকদের কতটা উপকার হল? বিঘে প্রতি আলু লাগানোর খরচ লেগেছে ১৫,০০০-২০,০০০ টাকা। কোথাও বা তারও বেশি। বৃষ্টির জলে সেসবই নষ্ট। কোথাও ক্ষেতে প্রায় এক হাঁটু জল। নতুন করে আবার আলু বসাতে বিঘে প্রতি ১০,০০০-১৫,০০০ টাকা বাড়তি লাগবে। তবে বৃষ্টির পরের দিন থেকেই বীজের দাম চড়তে শুরু করেছে। কালোবাজারি হলে খরচ আরও বাড়বে। বীজের গুণমান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যারা ৫-৬ বিঘা বা তার বেশি জমিতে আলু বসিয়েছিলেন, তাঁদের লোকসানের বহর বুঝতে অসুবিধা হয় না।

নতুন করে আবার কবে বসানো যাবে, জল সরে কবে জমি চাষযোগ্য হবে তা-ও অনিশ্চিত। ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয় চাষের সময়পঞ্জিই বদলে দিচ্ছে। একটা ফসলের দেরি হলে, পরের ফসলেরও হবে। তখন আবহাওয়াও সেই ফসল চাষের উপযুক্ত থাকবে না। আর আনাজ চাষে তো সেই সুযোগই নেই। যা নষ্ট হল, তা গেল।

অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মত এবারেও ক্ষতিপূরণের দাবি উঠছে। হয়ত সরকার তা দেবেও। কিন্তু পাবেন কারা? সেখানেও এনআরসির মত সবই কাগজের খেলা। জমির কাগজ চাই। চাষ করুক বা না করুক, ওই কাগজটাই সব। তাই ভাগচাষি কিছুই পান না। এই যে কৃষকবন্ধু থেকে শুরু করে এত প্রকল্প, কোনোটাই ভাগচাষি বা ক্ষেতমজুরের উপকারে লাগে না।

জমির মালিকানার কাগজ থাকলে, চাষ না করলেও, সব সরকারি সুযোগ মেলে। তাই ক্ষতিপূরণ বা ঋণ মকুবে অনেকেরই পৌষমাস। সরকারি নিয়মে কৃষকের অর্থ আসলে আলাদা। জমির মালিক চাষ না করলেও কৃষক। পাট্টা থাকলে কিছু সুবিধে তবুও মেলে। সেসব না থাকলে একজন চাষ করলেও সরকারের কাছে কৃষক নয়। আবার পরচা বা পাট্টা পেতেও রয়েছে সরকারি দপ্তরের হেনস্থা। সেখানেও দালালচক্র। দুর্যোগ যত বাড়ে,তত এক দলের আয় বাড়ে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ও সমবায় ব্যাঙ্কে নানা স্কিম রয়েছে। তারই সঙ্গে স্কিম করে ক্ষুদ্র কৃষক, ভূমিহীন কৃষকদের বঞ্চিত করার আয়োজনটাও পাকাপোক্ত। সেই সুযোগে ব্যবসা বাড়াচ্ছে মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানিগুলি। আধুনিক আইনসম্মত মহাজন। কৃষি অর্থনীতির সঙ্কটে গ্রামীণ অর্থনীতির মন্দা যত বাড়ে, তত তাদের ব্যবসা বাড়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ফসলের কম দাম, কালোবাজারি, মাইক্রোফিন্যান্সের কারবার সব মিলিয়ে যেন এক দুষ্টচক্র। আর সঙ্কট বাড়লেই ত্রাতা হয়ে আসরে নামে কর্পোরেট দানবরা।

কিন্তু এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ যদি স্বাভাবিক হয়ে যায়? নিউ নর্মালের যুগে অস্বাভাবিকতাকেই আমাদের স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে জলবায়ু বদলে যাচ্ছে। ঘন ঘন নিম্নচাপ আর ঘূর্ণিঝড় হতে চলেছে আমাদের নিত্যসঙ্গী। পরিণতি কত ভয়ঙ্কর হবে তার আঁচ আমরা পাচ্ছি। খাদ্যের দাম বাড়ছে। সেই সুযোগে মুনাফা লুটছে একদল ব্যবসায়ী। এমনিতেই কৃষিকাজ ছেড়ে গ্রাম বাংলার যুব প্রজন্মের বড় অংশ পেটের জ্বালায় চলে যাচ্ছে ভিনরাজ্যে। কৃষিজমির চরিত্র বদলাচ্ছে। এরপর এমন চলতে থাকলে খাদ্যসঙ্কট অবধারিত। তাই চাই সার্বিক পরিকল্পনা; ভাগচাষি, ক্ষেতমজুরদের জন্যও সহায়তা। সরকারি প্রকল্পগুলোর সুযোগ যাতে প্রকৃত কৃষকরা পান তার পরিকল্পনা। প্রতিটি ফসলের এমএসপি ঘোষণা করে, প্রকৃত কৃষকদের থেকে সরাসরি সরকারের কিনে নেওয়ার ব্যবস্থা। সেটা যেন ধান কেনার মতো না হয়, তা সুনিশ্চিত করা। রেশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে খাদ্যদ্রব্য ভর্তুকি মূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা। পরিবর্তিত জলবায়ুর উপযুক্ত কৃষি পদ্ধতির পরিকল্পনা।

বলা বাহুল্য বাজার অর্থনীতিতে এর নিদান নেই। সেখানে কেবলই আমাদের সর্বনাশ করে কর্পোরেটদের পৌষমাসের আয়োজন।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.