জানুয়ারি মাসের শুরুতে অক্সফ্যাম রিপোর্টে অসাম্যের লজ্জাজনক চিত্র আর মাসের শেষ সপ্তাহে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আমজনতার অর্থে কর্পোরেটের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির চিত্র। যে অস্বাভাবিকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জালিয়াতি, কারচুপি আর সরকারি মদত।
গত ২৪ জানুয়ারি আমেরিকার লগ্নি সংক্রান্ত গবেষণাকারী সংস্থা হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে উঠে এসেছে আদানি গোষ্ঠীর অসদুপায়ে বিপুল সম্পদ বৃদ্ধির আসল রহস্য। দুবছর ধরে করা তাদের অনুসন্ধানের রিপোর্ট অনুযায়ী, শেয়ার বাজারে কারচুপি করে নিজেদের স্টকের দাম বাড়িয়ে আদানি গোষ্ঠী সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। হিসাবে যেমন জালিয়াতি করেছে, তেমন কর দিতে হয় না বা নামমাত্র কর দিতে হয় এমন জায়গায় ভুয়ো কোম্পানি খুলে কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে। গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানির পরিবারের মোট সম্পদের পরিমাণ হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশের সময়ে ছিল ১২ হাজার কোটি ডলার। তার মধ্যে ১০ হাজার কোটি ডলারই এসেছে গত তিন বছরে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
গোষ্ঠীর অধীনস্থ সাতটি কোম্পানির শেয়ারের দাম এই সময়কালে ৮১৯% বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৮ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে আদানি টোটাল গ্যাস কোম্পানির – ২১২১%। অতিমারি আর মন্দায় যখন অর্থনীতির বেহাল দশা, তখন এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ কী? রিপোর্ট জানাচ্ছে আদানি গোষ্ঠী কৃত্রিমভাবে তাদের শেয়ারের দাম ৮৫% বাড়িয়েছে। এই কারচুপিতে কেবল সম্পদই বাড়েনি, শেয়ারের দাম দেখিয়ে তারা বিরাট বিরাট ঋণও নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, কোম্পানির সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে দেনা। সিএলএসএ-র রিপোর্ট জানাচ্ছে, গোষ্ঠীর অধীনস্থ পাঁচটি কোম্পানির (আদানি এন্টারপ্রাইজেস, আদানি পোর্টস, আদানি পাওয়ার, আদানি গ্রিন ও আদানি ট্রান্সমিশন) দেনা গত তিন-চার বছরে দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে দু লক্ষ কোটি টাকা।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট জানাচ্ছে, মরিশাস, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীসহ বিভিন্ন করে দিতে হয় না বা নামমাত্র কর দিতে হয় এমন জায়গায় ভুয়ো কোম্পানি খুলে বেআইনি আর্থিক লেনদেন করা হয়েছে। আদানি সংস্থার অর্থ ঘুরপথে বিদেশের এমন কোনো কোম্পানির কাছে গেছে, যা আসলে আদানিদেরই কোম্পানি। আবার সেই কোম্পানি আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কিনেছে। শেয়ারের চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে। এইভাবে লেনদেনের মধ্য দিয়ে কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে আম্বানিদের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগের গপ্পোও শোনানো হয়েছে। তা দেখিয়ে মিলেছে আরও ঋণ।
শেয়ারের দাম বাড়িয়ে পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধি শুধু নয়, বিভিন্ন কোম্পানিতে আদানি পরিবারের আধিপত্যও বজায় রাখা গেছে। সেবির নিয়মে কোনো কোম্পানিতে মূল কোম্পানির শেয়ার (প্রোমোটার) ৭৫ শতাংশের কম থাকতে হবে। অর্থাৎ অন্তত ২৫ শতাংশ শেয়ার থাকবে অন্য কোম্পানি বা ব্যক্তির হাতে। এ কারণেই ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার কেনা হয়েছে। আদানি গোষ্ঠীর চারটে কোম্পানিতে ৭২ শতাংশের বেশি শেয়ার তাঁর পরিবারের হাতেই রয়েছে। এগুলো হল আদানি এন্টারপ্রাইজেস, আদানি পোর্টস, আদানি পাওয়ার, আদানি টোটাল গ্যাস ও আদানি ট্রান্সমিশন। এটা খাতাকলমের হিসেব। পঁচাত্তর শতাংশের কম শেয়ার আইনসম্মত। কিন্তু অভিযোগ হল ঘুরপথে ভুয়ো কোম্পানির নামে শেয়ার কিনে পরিবারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করা হয়েছে। শুধুমাত্র মরিশাসেই এরকম পাঁচটা সন্দেহজনক কোম্পানি রয়েছে। যেমন আদানি টোটাল গ্যাসে মূল সংস্থার শেয়ার খাতায় কলমে রয়েছে ৭৪.৮০%। কিন্তু সন্দেহ করা হচ্ছে, আরও ৪.৩৪% শেয়ার অন্য কোম্পানির নামে আদানি পরিবারের হাতেই গেছে। অর্থাৎ বাস্তবে প্রায় ৮০% শেয়ারের মালিক আদানি পরিবার। এছাড়া, আদানি উইলমারে তাদের শেয়ার রয়েছে প্রায় ৮৮%। ২০২৫ সালের মধ্যে এই অংশীদারিত্ব কমাতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এই কোম্পানির মাধ্যমে আদানি বিগত কয়েক বছরে মধ্যে ভোজ্য তেল, চাল, গম সহ খাদ্য ব্যবসার বাজারে প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করেছে। নামে যৌথ মূলধনী কোম্পানি। আসলে ফলভোগ করছে আদানি পরিবার। অথচ দায় সীমিত হওয়ায় লোকসানের বোঝা বেশি বইতে হবে না। সেটা বইবে আমজনতা।
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশের পরে সে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আদানি গোষ্ঠীর অভিযোগ এই রিপোর্ট শুধু মিথ্যাই নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও। হিন্ডেনবার্গের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। রিপোর্ট প্রকাশের পর, শেয়ার বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আদানির বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার দর নেমেছে।
Gautam Adani's net worth has taken a nearly $40B hit. He's now just worth just over $80 billion… ☹️ pic.twitter.com/UmJQAuQVuO
— David Ingles (@DavidInglesTV) January 30, 2023
আদানির এই ক্ষতিতে কেবল আদানি নয়, লাইফ ইনশিওরেন্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার মত সংস্থারও ক্ষতি। স্টেট ব্যাঙ্কেরও বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামীদিনে এই সংস্থাগুলোতে টাকা জমা রাখা আমজনতার কোটি কোটি টাকার ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। আদানির কত লোকসান হল তার চেয়েও বড় কথা আমজনতার এই লোকসানের আশঙ্কা। এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্কের লোকসান কেন হল? কারণ এদের হাতে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার রয়েছে। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো আদানির কোম্পানিগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণও দিয়েছে। কারচুপি করে শেয়ার দর ৮৫% বাড়িয়ে রাখায় সেই বাড়তি দরেই শেয়ার কিনতে হয়েছে। শেয়ার দর মূল দামে ফিরে এলে বা তার চেয়েও নেমে গেলে বিপুল লোকসান হবে।
এই নিয়ে হইচইয়ের জেরে এলআইসি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত তাদের মোট অ্যাসেটস আন্ডার ম্যানেজমেন্ট (AUM) ৪১.৬৬ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। সুতরাং আদানি গ্রুপে তাদের লগ্নি ‘বুক ভ্যালু’ অনুসারে মোট AUM-এর মাত্র ০.৯৭৫%।

তবু জেনে রাখা ভাল, এলআইসি আদানি গোষ্ঠীর সাতটা কোম্পানির (সম্প্রতি অধিগৃহীত এসিসি ও অম্বুজা সিমেন্ট সহ) শেয়ার কিনেছে। আদানি পোর্টসে এলআইসির শেয়ার নয় শতাংশের বেশি। সরকার জলের দরে বন্দর বেচে দিচ্ছে। আবার বেসরকারি কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার থেকে ধার নিয়ে বা তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে সম্পদ বাড়াচ্ছে। ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এলআইসির হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের জেরে আদানির শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় এল আইসির প্রায় ১৯,০০০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। এছাড়া বিদেশি ব্রোকারেজ হাউস সিএলএসএ-র এক রিপোর্ট অনুসারে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলোর আদানি গ্রুপে ‘এক্সপোজার’ ৮১,২০০ কোটি টাকার।
আদানির প্রধান পাঁচ কোম্পানির দু লক্ষ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ব্যাঙ্কগুলো থেকে নেওয়া হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা। শেয়ারের দাম চড়া বলে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো বেশি ধার দেয়নি, দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের একটা অংশ দেওয়া হয়েছে কোম্পানির শেয়ার কিনে। যাকে বলা হয়, ‘প্লেজিং অফ শেয়ার’। শেয়ারের দাম চড়া বলে ঋণের অর্থমূল্যও বেশি। এতে ঝুঁকি থাকে। শেয়ারের দাম কমলে ঋণদাতার ক্ষতি, যে ঋণ নিচ্ছে তার ঝুঁকি কম। আদানির স্বার্থে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক সেই ঝুঁকি নিয়েছে। সাধারণত কোম্পানিগুলো বিশেষ প্রয়োজনে বা আর্থিক দুরবস্থায় এভাবে শেয়ারের বিনিময়ে ধার নেয়। যে কোম্পানির কর্ণধার বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি, যে গোষ্ঠীর সম্পদের পরিমাণ দুবছরে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে, তাকে এমন করতে হল কেন? আসলে সম্পদ বেড়েছে এমনভাবেই। কারচুপি করে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে। শেয়ার বাজারে লাভ করে এভাবেই কর্পোরেট সংস্থাগুলো সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। যার সঙ্গে বস্তুগত উৎপাদন বৃদ্ধি বা মূল্য সৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
রিপোর্ট প্রকাশের পরে যথারীতি রাজনৈতিক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সখ্য সকলের জানা। সখ্য না বলে অশুভ আঁতাত বলাই ভাল। সরকারের বদান্যতাতেই আদানির সাম্রাজ্য বিস্তার। তারা একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কিনে নিয়েছে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করার সুযোগ পেয়েছে। এমনকি বিদেশি বন্ড কেনার ক্ষেত্রেও নানা অভিযোগ রয়েছে। আবার বিদেশি মুদ্রায় বিপুল পরিমাণ বন্ড কেনায় বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারেও তার প্রভাব পড়তে পারে, যা ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমাতে পারে। ইতিমধ্যেই তা তলানিতে।
স্বয়ং আদানি অবশ্য অভিযোগ করেছেন হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এমনকি এই রিপোর্ট নাকি ভারত ও তার স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আক্রমণ। হতেই পারে কর্পোরেট রেষারেষিতে আদানি গোষ্ঠীর প্রতিযোগীরা এটা করিয়েছে। কিন্তু তা বলে অভিযোগগুলো মিথ্যা হয়ে যায় না। হিন্ডেনবার্গ ইতিমধ্যেই কড়া প্রত্যুত্তর দিয়েছে। তাদের স্পষ্ট ঘোষণা “Fraud cannot be obfuscated by nationalism or a bloated response that ignores every key allegation we raised.” গোদা বাংলায় বললে, প্রতারণাকে জাতীয়তাবাদ দিয়ে অথবা মূল অভিযোগগুলোর প্রত্যেকটাকে পাশ কাটিয়ে কিছু বড় বড় কথা বলে ঢাকা দেওয়া যায় না। তারা আরও বলেছে, আদানির ৪১৩ পাতার দীর্ঘ জবাবের মধ্যে মোটে পাতা তিরিশেক রিপোর্টে যে প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে সেই সংক্রান্ত। আদানির ব্যবসা নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণের আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা সম্পর্কে হিন্ডেনবার্গের বক্তব্য “…we believe India is a vibrant democracy and an emerging superpower with an exciting future. We also believe India’s future is being held back by the Adani Group, which has draped itself in the Indian flag while systematically looting the nation.” অর্থাৎ সংস্থার মতে ভারত এক সজীব গণতন্ত্র এবং এমন এক দেশ যা ক্রমশ মহাশক্তি হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কিন্তু সেই ভবিষ্যতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আদানি গ্রুপ, যা নিজের গায়ের জাতীয় পতাকা জড়িয়ে নিয়ে নিয়ম করে দেশটাকে লুঠ করছে।
এই প্রত্যুত্তরে হিন্ডেনবার্গ সংস্থা আরও একটা কথা বলেছে যা নিয়ে আদানির জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে প্রশ্ন করা উচিত। হিন্ডেনবার্গ লিখছে
The Adani Group has not even attempted to clarify its relationship with a Chinese National (Chang Chung-Ling), despite a plethora of linkages. We had asked: What is the nature of Chang Chung-Ling’s relationship with the Adani Group, including his relationship with Vinod Adani?
This is an important matter, not only for shareholders but also India’s national interest because:
An entity (Gudami International) run by Chang Chung Ling (aka Lingo Chang) was said to have been part of a massive corruption scheme in the AgustaWestland Scandal, one of India’s largest and ongoing bribery scandals.
The son of Chang Chung Ling is the beneficial owner of the major contractor to the Adani Group called PMC Projects, mentioned above.
অর্থাৎ চীনা নাগরিক চ্যাং চুয়াং-লিংয়ের সঙ্গে আদানি গ্রুপের, বিশেষত কর্ণধার গৌতমের ভাই বিনোদ আদানির সম্পর্ক কী, সে প্রশ্ন হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে তোলা হয়েছিল। ৪১৩ পাতার কোথাও সে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা নেই। প্রশ্নটা কেবল আদানি গ্রুপের শেয়ার হোল্ডার নয়, ভারতের জাতীয় স্বার্থের। কারণ এই চীনা নাগরিকটির মালিকানাধীন গুদামি ইন্টারন্যাশনাল আগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড অনলাইন ঘুষ কেলেঙ্কারিতে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। চ্যাং চুয়াং-লিংয়ের সুপুত্র আদানি গ্রুপের প্রধান কনট্রাক্টর পিএমসি প্রোজেক্টসের অন্যতম মালিক।
আসলে হিন্ডেনবার্গের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, আদানি গোষ্ঠীর প্রতি মোদী সরকারের বদান্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার একে নিছক আদানি আর মোদী সরকারের আঁতাত বলেও ব্যাখ্যা করা চলে না। এটাই আজকের পুঁজিবাদ। শাসক দল, নানা প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট সংস্থার আঁতাতে চলা ধান্দার পুঁজিবাদ। যেখানে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বদলে ফাটকা কারবার, জালিয়াতি, কারচুপি, লুঠের মধ্য দিয়ে লগ্নি পুঁজি ফুলে ফেঁপে ওঠে। বিভিন্ন কর্পোরেটের সম্পদ বাড়ে, বিনিময়ে আরও রিক্ত হন আমজনতা।
আজ বিশ্বজুড়ে চলছে এই কারবার। অতিমারীতে সার্বিক মন্দা চললেও শেয়ার বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। লকডাউনের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বাজার চাঙ্গা হয়। ২০২১ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট (‘দি ইনইকুয়ালিটি ভাইরাস’) জানিয়েছে, ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বের বিলিয়নেয়ারদের (যাদের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার বা তার বেশি) সম্পত্তি প্রায় চার লক্ষ কোটি ডলার বেড়ে গিয়েছিল। বিশ্বের দশজন শীর্ষস্থানীয় ধনীর সম্পদ বাড়ে ৫৪ হাজার কোটি ডলার। অতিমারীর জন্য সরকারি নানা আর্থিক সুযোগ যেমন তারা পেয়েছিল, তেমনই শেয়ার বাজার তেজি হওয়াতেও তাদের লাভ হয়। ভারতেও লাভবান হয় আম্বানি, আদানির মত বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা। ২০২০ সালের মার্চে আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ড্রাস্টির মোট ঋণ ছিল এক লক্ষ ৬১ হাজার কোটি টাকা। লকডাউনের প্রথম ৫৮ দিনে কোম্পানি এক লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করে। এই আয়ের বেশিরভাগটাই আসে শেয়ার কেনাবেচার মধ্য দিয়ে। মুকেশ আম্বানির লকডাউনের সময়ে প্রতি ঘন্টায় আয় হয় ৯০ কোটি টাকা, গৌতম আদানির প্রায় ২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ শিল্পক্ষেত্রে মন্দা চললেও, লগ্নি পুঁজির কারবার অতিমারীতে রমরমিয়ে চলেছে।
নয়া উদারনীতিতে কর্পোরেটদের নানা আর্থিক সুবিধা দেওয়া, বেল আউটের নামে সরাসরি অর্থসাহায্য দিয়ে আমজনতার জন্য রাষ্ট্রের বরাদ্দ কমানো হয়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নামমাত্র কর দেওয়ার জায়গাগুলোকে ব্যবহার করে কর্পোরেটগুলোর কোটি কোটি টাকা কর ‘আইনসম্মতভাবে’ ফাঁকি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ওইসব ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’-এ কোম্পানি খুলে অর্থ চালান করা হয়। আবার ঘুরপথে সেই অর্থই নিজের দেশে বিনিয়োগ করা হয়। গোটা প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ, ধোঁয়াটে। ভারতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ হয় সিঙ্গাপুর থেকে, তৃতীয় স্থানে রয়েছে মরিশাস। সিঙ্গাপুরে কর্পোরেট করের হার কম, মূলধনী লাভে কর দিতে হয় না। তাই সেখানে কোম্পানি খুলে ঘুরপথে এদেশে বিনিয়োগ করার সুবিধে রয়েছে। মরিশাসেও এই করের হার নগণ্য। কর্পোরেটদের সুযোগ দেওয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দুর্নীতি, কারচুপি। আদানির মত কর্পোরেটগুলো যার অংশীদার।
আরো পড়ুন ফাঁপা আদানি গোষ্ঠীর গ্রাসে এনডিটিভি
এইসব কারচুপিতে সরকারের রাজস্ব কমে; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা কোম্পানিগুলো সঙ্কটে পড়ে। ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থার অর্থ মানে আমজনতার অর্থ। তা ঘুরপথে যায় কর্পোরেটের হাতে। ঋণশোধ না করার তালিকাতেও কর্পোরেট সংস্থাগুলোই সামনের সারিতে থাকে। ঋণ আদায়ের বদলে ঘুরপথে তাদের ঋণ মকুব করা হয়। যার অন্যতম কৌশল হল, অনাদায়ী ঋণ মুছে দেওয়া, যার পরিভাষিক নাম ‘ব্যাড ডেট রাইট অফ’। ২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২ – এই ছ বছরে ১১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অনাদায়ী ঋণের হিসাব এভাবেই মুছে দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রক সংসদে এই তথ্য দিয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর রাইট অফের পরিমাণ আট লক্ষ কোটি টাকার বেশি। সেই তালিকায় প্রথমেই রয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক।
সরকারের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ – এই চার আর্থিক বছরে এমন ৯০ শতাংশ ঋণ আদায় করা যায়নি। একইসঙ্গে বেড়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাঙ্কের টাকা লুঠ করা। নীরব মোদী, মেহুল চোকসিদের মতো জালিয়াতরা ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা লুঠ করে, আর ব্যাঙ্কের লোকসানের বোঝা চাপে আমানতকারীদের উপর। নানা জরিমানা ও সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে আমানতকারীদের পকেট কাটা হচ্ছে। এলআইসির মত লাভজনক বিমা সংস্থাকেও আর্থিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে।
লগ্নি পুঁজির দাপট যত বেড়েছে, তত ফাটকা কারবার, চটজলদি মুনাফার প্রবণতা বেড়েছে। শেয়ার বাজারসহ বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনে বিনিয়োগ করে তাড়াতাড়ি মুনাফা পাওয়া যায়। তাই পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বাড়ে। শেয়ার বাজারের পাশাপাশি বেড়েছে মিউচুয়াল ফান্ডের গুরুত্ব। চটজলদি মুনাফার যেমন সুযোগ আছে, তেমন রয়েছে বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা। থাকে ছোট বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত হওয়ার আশঙ্কা। বিগত শতকের নয়ের দশকে ভারতে ইউনিট ট্রাস্ট কেলেঙ্কারির কথা অনেকেরই মনে আছে। লগ্নি পুঁজি থিতু হয়ে বসতে শেখে না। কখন আসবে, কখন ধসিয়ে দিয়ে চলে যাবে কেউ জানে না। তার দর্শন – এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। সেই লুঠের চড়া দাম আদানিদের নয়, আমজনতাকে দিতে হয়। একটা রিপোর্টেই শেয়ারের দর কমে ব্যাঙ্ক, বিমা কোম্পানির লোকসান করে দেয়। পেনশন তহবিলের অর্থও ফাটকা কারবারে বিনিয়োগ করা হয়। আদানির শেয়ারেও এই তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছিল। তাই পেনশন প্রাপকদেরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
লগ্নি পুঁজির দাপটে ঋণনির্ভর অর্থনীতি গুরুত্ব পায়। কর্পোরেটদের সম্পদ আর দেনা – দুটোই বাড়ে। আবার সাধারণ ক্রেতাদেরও ঋণের উপর নির্ভরতা বাড়িয়ে বাজার চাঙ্গা রাখার ব্যবস্থা হয়। নয়া উদারনীতি চাহিদায় নয়, জোগানে গুরুত্ব দেয়। কেনার ক্ষমতা না থাকলে ধার করে ঘি খাও। শেষে যে আর্থিক উন্নয়নের বুদ্বুদ ফেটে যায়, তা ২০০৭-০৮ সালের মন্দাই প্রমাণ করে দিয়েছে। সেই মন্দার প্রভাব আজও রয়েছে। ক্রয় ক্ষমতা কমায় চাহিদা কমছে। গলদটা আসলে বিসমিল্লায়। একশো ছয় বছরেরও বেশি আগে ১৯১৬ সালে লেনিন পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তরকে মরণাপন্ন পুঁজিবাদ বলেছিলেন। পুঁজিবাদের মরণদশা কাটার কোনো লক্ষণই নেই। মৃত্যুঘন্টা কবে বাজবে সেটাই অবশ্য বড় প্রশ্ন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।