আরিফুজ্জামান তুহিন
তখন অনার্স শেষ করেছি। ২০০৫ সালের শেষদিক, ফল প্রকাশের জন্য তাড়াহুড়ো ছিল না। কারণ আমি ও আমার বন্ধুরা তখন বিশ্বাস করতাম বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির কলোনিয়াল পড়াশোনা করে লাভ নেই। আমরা চারু মজুমদারের লাইন পুরোপুরিভাবে না নিলেও উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমাদের একটা নেতিবাচক ধারণা ছিল। সে কারণে আমাদের অনেক বন্ধু বিদেশে উচ্চশিক্ষার বড় সুযোগ পেলেও যায়নি। সে আরেক তর্ক।
আমরা তখন অনেককিছু করতাম। যা প্রধানত করতাম তা হল শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনের জন্য নানা ধরনের চেষ্টা। কারণ শ্রমিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমরা একটা ব্যাপক শ্রেণিভিত্তিক কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম। বাংলাদেশে যতগুলো কমিউনিস্ট পার্টি আছে আকাশে ততগুলো নক্ষত্র আছে কিনা তা নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করলেও এইসব পার্টিগুলোর একটাতেও যে শ্রমিক, কৃষকের প্রতিনিধি নেই এবং পার্টিগুলোর শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য কোনো কর্মসূচি নেই – এটা স্বীকার করতে ওইসব কমিউনিস্ট পার্টির পাকা পাকা কমিউনিস্টদের কোনো আপত্তি নেই।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ঠিক এরকম সময়ে খবর এল, বাংলাদেশের দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে একটা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির কয়লাখনি হবে। এর মালিক ব্রিটিশভিত্তিক একটা কোম্পানি, নাম এশিয়া এনার্জি। পরে এই কোম্পানির নাম হয় জিসিএম। কোম্পানি মোট কয়লার ৯৪ ভাগ মালিকানা পাবে, বাকি ছ ভাগ পাবে বাংলাদেশ সরকার। খনির সময়কাল তখন ৫০ বছর ধরা হয়েছিল।
২০০৫ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সক্রিয় ছিলাম বা বলা যেতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের তখনকার উপস্থিতি ক্রিয়াশীল যে কোনো বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের তুলনায় বেশ মজবুতই ছিল। আমরা যে কোনো ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ছাত্রদের পক্ষে রাখার মত যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেছিলাম।
আমাদের এই গ্রুপটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করার আগে প্রগতির পরিব্রাজক দলের (প্রপদ) অভ্যন্তরে সব থেকে বড় শক্তি ছিল। একটা পর্যায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে ’সংস্কৃতির নয়াসেতু’ নামক সংগঠনের জন্ম হয়। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন শ্রমিক কৃষকের পার্টি বানানোর জন্য এটা নিরেট একটা বুদ্ধিবৃত্তিক নাম। কিন্তু আমরা মাও সে তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শুরু দিয়েই সংগঠন গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলাম। সে কারণে নতুন ধরনের সংস্কৃতি নির্মাণের কথা বলতাম।
ফুলবাড়ি আন্দোলনে আমাদের মধ্যে নানা ধরনের মত ও পথের মানুষ বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন থেকে এসেছিলেন। এর মধ্যে আমি ছিলাম বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে আসা এবং ওই দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সক্রিয় কর্মী সংগঠক। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে বুঝতে পারলাম, ওই দলের মধ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ন্যূনতম চরিত্র নেই। এভাবেই আমরা আমাদের সময়ের বহু বামপন্থীর থেকে এগিয়ে ছিলাম। আমরা তখন সক্রিয় হয়েছিলাম মূলত একটা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে। সংগত কারণে আমাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম এবং মাওবাদের প্রতি। যদিও বাংলাদেশের বিদ্যমান মাওবাদী পার্টিগুলো তাদের সশস্ত্র লাইন পরিত্যাগ করে শান্তিবাদী গানবাজনার ধারায় পরিণত হয়েছিল। আর সে কারণে আমরা নিজেরাই পার্টি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম তখন।
দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি আমরা আসলে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম একটা গণআন্দোলনের ভেতর দিয়ে কীভাবে পার্টি গড়ে তোলার সাধারণ তত্ত্ব ও কৌশলগুলো আয়ত্ত করা যায়। ফুলবাড়ি কয়লাখনি আন্দোলনে যুক্ত হবার পেছনে আমাদের দুটো উদ্দেশ্য ছিল। একটা হল উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি এবং বিদেশী কোম্পানির লুঠপাট ঠেকানো। দ্বিতীয়টা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য একটা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা।
ফুলবাড়িতে ছাত্ররা
বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের সুতিকাগার বলা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা প্রভাব গোটা দেশ জুড়ে ছিল। এমনকি আজ থেকে দেড় দশক আগেও এটা টাটকা ছিল। ফলে আমাদের দলটা যখন ফুলবাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল, সেখানকার কৃষক ও মধ্যবিত্তরা সেটা সানন্দেই নিয়েছিলেন। দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য আমরা ফুলবাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। তবে অধিকাংশ সময় আমরা ফুলবাড়ির বিভিন্ন কৃষক ও আদিবাসীদের আশ্রয়ে থাকতাম।
ফুলবাড়ি বলা হলেও কয়লাখনির এলাকা ছিল বিরামপুর ও হাকিমপুরেও। ফুলবাড়ি, বিরামপুর ও হাকিমপুর মূলত উপজেলা। ইংরেজিতে যাকে সাব-ডিস্ট্রিক্ট বলা হয়ে থাকে। আমরা সনাতন বামপন্থী কায়দায় প্রচার করতাম। এই এলাকা একসময় নকশাল আন্দোলনের উর্বর জমি ছিল। এলাকার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ আদিবাসী, যাঁদের সাওতাল বলা হয়। আমার এখনো মনে আছে, আমরা সবথেকে বেশি আশ্রয় পেয়েছিলাম ভূমিহীন কৃষক এবং এঁদের কাছেই।
যে ধরণের প্রচার করেছিলাম
আমরা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির উপর বিশদ তত্ত্বতালাশ করি। বলা যায় ভাল রকম পড়াশোনা। আমাদের এই তত্ত্বতালাশের সঙ্গে আমরা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ জল ও মৃত্তিকা অধ্যাপক বিজ্ঞানী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করি।
এইসব বিজ্ঞানী ও গবেষকরা আমাদের ফুলবাড়িসহ দিনাজপুর এলাকার মাটির গঠন, সেখানে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে পরিবেশের উপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে তার বিস্তারিত তথ্য দিলেন। তার মধ্যে ছিল প্রতিদিন কত কিউসেক (প্রতি সেকেন্ডে কত ঘনমিটার) জল তোলা হবে খনিকে শুষ্ক রাখতে তার হিসাব, এই বিপুল পরিমাণ জল তুললে তার প্রভাব আশপাশের কত জেলায় ছড়িয়ে পড়বে তার হিসাব, এতে কীভাবে মরুকরণ হবে তার হিসাব।
আমরা গবেষকদের হিসাব নিয়ে গ্রামে গ্রামে যেতাম, তাদের সঙ্গে খনি নিয়ে আলাপ আলোচনা করতাম। বাংলাদেশে তার আগে দিনাজপুরে একটা সুড়ঙ্গ পদ্ধতির কয়লাখনি হয়েছিল। তখন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন (বর্তমানে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের সঙ্গী) বলেছিলেন, এলাকায় খনি হলে মানুষের অবস্থা পাল্টে যাবে। বাস্তবে মানুষ আরও গরিব হয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড খনি হবার পরও এলাকায় জল নেই, খাবার জলের তীব্র হাহাকার। আমরা দেশের মধ্যেই অবস্থিত এরকম পরিবেশ ও মানুষ বিধ্বংসী প্রকল্পকে উদাহরণ হিসাবে দেখাতাম। আর মানুষ ভিটেমাটি ও ফসলের জমি থেকে উচ্ছেদ হবে এই উৎকণ্ঠা তো ছিলই। ফলে দ্রুত মানুষ জোট বাঁধতে থাকে।
আমরা গ্রামের মাটির ঘরের দেয়ালে দেয়ালে লিখতাম, “কয়লা খনি চাই না”। একদিন এরকম প্রচার শেষ করে শেল্টারে ফিরছি, দেখি সদ্য কালি দিয়ে লেখা “কয়লা খুনি চাই না”। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম মনে হয় বানান ভুল করে খনিকে খুনি লিখেছে। পরে খোঁজ করে জানলাম বানান ভুল করেনি গ্রামবাসীরা। তারা খনিকে খুনিই মনে করে। সত্যিই তো তাই। মানুষের ফসল ফলানোর জমি আর ভিটে কেড়ে নেওয়া তো খুন করাই। আমাদের চেয়েও দ্রুত গ্রামবাসীরা বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল, কারণ লড়াইটা ছিল তাদের। আমরা তো শহর থেকে যাওয়া কিছু মানুষ।
এইভাবে খনি এলাকার প্রত্যেক গ্রামে কমিটি তৈরি হতে শুরু করল। সেইসব কমিটির নিয়মিত কাজ ছিল নিজেদের এলাকায় কর্মসূচি প্রচার করা। আর ছিল আমাদের নাটক ও গানের দল। তারা অদ্ভুত একটা নাটক করত খনি নিয়ে। সেই নাটক তারা গ্রামে গ্রামে প্রচার করত, খালি গলায় নাটকের সংলাপ বলত। সেই নাটক দেখতে নারী পুরুষ বাচ্চা কিশোর কিশোরীরা ভিড় করে দাঁড়াত। গান করতেন কফিল আহমদ। কফিল ভাইয়ের গানের লিরিক শুধু গান নয়, বিপ্লবের আয়াত। একেকটা শব্দ যেন আমাদের বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটত। আমি দেখতাম কৃষক সেই গান শুনে ক্ষেতের কাজ ফেলে চলে আসত। তার চোখে মুখে ভয়াবহ বিপ্লবের ফুল।
মানুষ যেভাবে রুখে দাঁড়ায়
যেহেতু আমরা খনিবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা ব্যাপক শ্রেণিভিত্তিক পার্টি গঠনের চেষ্টা করছিলাম, সে কারণে আমরা মানুষের প্রতিক্রিয়া ও অংশগ্রহণ খুব মন দিয়ে খেয়াল করতাম। আন্দোলন সংগঠিত করতে আমরা খনি এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রাম ইউনিয়নে সমাবেশ করতাম। আমাদের সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হতেন। সেখানে আমরা বক্তৃতা করতাম। মানুষকে সশস্ত্র হতে আহ্বান জানাতাম।
এক গ্রামে আমরা প্রচার শেষ করে শেল্টারের পথে ফিরব, প্রত্যেক বাড়িতে বাঁশ কেটে রাখতে বলতাম। আমাদের সমাবেশে বাঁশ নিয়ে যাবার কথা প্রচার করতাম। প্রতিটি বাঁশের লাঠি আড়াই হাত করে কাটতে বলতাম। একটা বাঁশে এরকম চার-পাঁচটা ভাল লাঠি হত। একটা আমরা কমিটির লোকেরা নিয়ে আসতাম। কারণ অনেক বাড়িতে বাঁশ ছিল না, তাদের আমরা লাঠি দিতাম।
এক বাড়িতে গিয়েছি, দেখি ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তাঁকে বললাম “চাচা, বাঁশের লাঠি কাটবেন না?” তিনি আমাকে যে জবাব দিয়েছিলেন তার মধ্যেই ছিল প্রকৃত সশস্ত্র কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের লাইন। তিনি আমাকে একটা দা দেখান। স্থানীয় ভাষায় এই ধরনের লম্বা বা বড় দাকে হাঁসুয়া বলে, আর খুলনা, যশোর অঞ্চলে বলে রামদা। সেই বৃদ্ধ দাটি হাতে নিয়ে বললেন “আমার মন বলে কোম্পানির ঘাড়ে কোপ দিস। কিন্তু বাজান দা তো মানে না। আমি লাঠি নিয়ে আসব না, এই দা নিয়ে যাব।”
মানুষ আসলে প্রথমে সশস্ত্র হয় মনে, তারপর সশস্ত্র হয় অস্ত্রে। যদি মনের ভেতর কোনো মানুষ সশস্ত্র হন, তাহলে সেই সশন্ত্র মানুষকে আর ধরে রাখা যায় না। কোনো ট্যাংক, কামান, বন্দুক দেখিয়ে তাকে নিরস্ত্র করা যায় না। আমরা মানুষকে সশস্ত্র করতে পারিনি। বরং সশস্ত্র না করে একটা বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে বলেছি, শ্রেণিশত্রু খতম করো। এভাবে বিপ্লব হয় না।
ফুলবাড়ি শুধু বাংলাদেশের জন্যই এক উজ্জ্বল নাম নয়। সারা দুনিয়ায় যেখানে অন্যায় উচ্ছেদ হবে আগামীদিনে এবং এখন হচ্ছে, সেখানকার মানুষের লড়াইয়ের জন্য ফুলবাড়ি চিরকাল ফুল হয়ে থাকবে। সেই ফুল থেকে বিদ্রোহ, বিপ্লবের গন্ধ ছড়াবে। সে গন্ধের সামনে বন্দুক-কার্তুজ বেকার।
লাল সেলাম ফুলবাড়ি।
নিবন্ধকার বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক, ফুলবাড়ি আন্দোলনের এক সময়কার কর্মী। মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
মওলানা ভাসানী: জনগণের পবিত্র হিংসার প্রফেট
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।