সম্প্রতি একটি বাংলা খবরের কাগজে কুমার রাণা সঠিকভাবেই নতুন করে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন (মিত্র হয়ে উঠল ‘শত্রু’, কুমার রাণা; আনন্দবাজার পত্রিকা ১৯ এপ্রিল ২০২৩)। দলিত আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন – উভয় আন্দোলনেই রয়েছে পরস্পরের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস, অসূয়া এবং কুসংস্কার। কুমার রাণা লিখেছেন, “সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল দুপক্ষের মধ্যে মিত্রতা ও ঐক্য – একটি সাধারণ মঞ্চের নির্মাণ। অথচ যত দিন গেছে, দুপক্ষের নেতাদের মধ্যে শত্রুতা ও অবিশ্বাস বেড়েছে।” সঠিক পর্যবেক্ষণ। আজকাল অনেকেই এটি স্বীকার করেন। যদিও এখনো পর্যন্ত কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দলগুলি এবং তাত্ত্বিকদের মধ্যে পাল্লা ভারি তাঁদেরই যাঁরা মনে করেন আম্বেদকরের রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে পরিচয়ের রাজনীতি যা কমিউনিস্ট শ্রেণি রাজনীতির প্রতি শত্রুতামূলক। সুতরাং পারস্পরিক শত্রুতাই এক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কিন্তু ধীরে হলেও নিশ্চিত গতিতে ভিন্নমতের লোকেদের সংখ্যাও এই শিবিরে বাড়ছে যাঁরা, কুমার রাণার সঙ্গে একবাক্যে সহমত হবেন।

এখন কথা হল, এমনটি হল কেন? কী সেই কারণ যা স্বাভাবিক মিত্রদের মধ্যে মিত্রতা গড়ে উঠতে দিল না, বরং তাঁদের ঠেলে দিল দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতার দিকে? এই প্রশ্নটি আমাদের গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করার দরকার, নইলে আমরা হাজার শুভ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই ভুল শোধরাতে পারব না। কুমার রাণা কী মনে করেছেন এই প্রশ্নে? তিনি লিখেছেন, “বিশ্বাস বিষম বস্তু। মিত্রকে শত্রু করে তুলতে এর জুড়ি নেই। এই বিশ্বাস থেকেই সম্ভবত ভারতীয় মার্কসবাদীরা ১৯৩০-এর দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে বি আর আম্বেডকর নামক একাধারে মহা পন্ডিত এবং দক্ষ সংগঠকের উত্থানকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন! তাঁকে করে তোলা হল শত্রুপক্ষের চর!” তাহলে, কুমার রাণার মতে, বিশ্বাস বা বলা ভাল অন্ধ বিশ্বাসই হল সেই লুক্কায়িত কারণ যা অনেক ক্ষেত্রেই যা করে এক্ষেত্রেও তাই করেছে। অর্থাৎ স্বাভাবিক মিত্রের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে উঠতে দেয়নি, বরং তাদের মধ্যে তৈরি করেছে সন্দেহের বীজ, যা এক দীর্ঘস্থায়ী হঠকারী শত্রুতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমার মতে এভাবে দেখলে সে দেখা হবে অতি সরলীকৃত। খেয়াল করলে দেখা যাবে, কমিউনিস্টরা শুধুমাত্র আম্বেদকরের মতো ব্যক্তিত্বকেই সন্দেহের চোখে দেখেননি, ‘শত্রুর চর’ বলে মনে করেননি, নিজেদের অনেক কমরেডের বেলাতেও তাই করেছেন। কিছুদিন একসাথে কাজ করার পরেই একদল কমিউনিস্ট অন্য দল বা ব্যক্তিকে সন্দেহের চোখে দেখেছে এবং শেষ পর্যন্ত ওই শত্রুর চর অভিধায় ভূষিত করেছে এবং তীব্র শত্রুতায় জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি এই শত্রুতা খুনোখুনিতেও পৌঁছে গেছে। বিচার’ করে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে দীর্ঘকালের সাথীদের। ওই ১৯৩০-এর দশকেই রাশিয়ার কুখ্যাত ‘পার্জ’ এবং মস্কো বিচারের ঘটনাবলী আমরা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। কিন্তু যেখানে কমিউনিস্টদের মধ্যেকার সম্পর্ক খুনোখুনিতে পৌঁছয়নি, সেখানেও আমরা পারস্পরিক নাকচ, বিস্মরণ, বিস্মৃতি ইত্যাদির মত কম ঘনত্বের শত্রুতার নানা উদাহরণ দেখতে পাব। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি শুধু তো আম্বেদকরকেই শত্রুর চর বানায়নি, মানবেন্দ্রনাথ রায় বা অবনী মুখার্জীর মত পার্টি প্রতিষ্ঠাতাদেরও ওই তকমা দিয়েছে। পরবর্তীকালে এই খেলা অব্যাহত থেকেছে নতুন নতুন চেহারায়। এসবের পিছনে কী আছে? যা আছে, তাকে কি আমরা বিশ্বাস বা অন্ধ বিশ্বাস বলে ব্যাখ্যা করতে পারব? আমার তা মনে হয় না। এভাবে দেখলে অতিসরলীকরণের গাড্ডায় পড়তেই হবে।

এসবের প্রধান কারণ হল ভাবনাচিন্তা ও ধ্যানধারণার পার্থক্য। যদিও একটি কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে, যে এভাবেও আমরা সবটুকু বুঝে উঠতে পারব না। অনেক রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে যা আসলে বানানো – বুঝেও সচেতনভাবে না বোঝা। বিষয়টির আরও গভীরে গেলে পাওয়া যাবে এক রহস্যময় বস্তুকে। যাকে বলা যেতে পারে পুরুষ ইগো। এই রহস্যময় বস্তুটির রহস্যময় আচরণ সমাজ পরিবর্তনের সমস্ত পবিত্র লড়াইয়েরই বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে তা আজ খুব পরিষ্কার। কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনায় খুব সচেতনভাবেই তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলত তা অনালোচিত। এখানে আমিও সেই আলোচনায় ঢুকব না, কিন্তু বিষয়টি উত্থাপন করে রাখলাম, কারণ কখনো না কখনো এর আলোচনায় আমাদের ঢুকতেই হবে। নইলে অনেক সমস্যারই গভীরে যেতে সমস্যা হবে। বর্তমান আলোচনায় আমি কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে কীভাবে কমিউনিস্ট-দলিত রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষিয়ে গেল এবং স্বাভাবিক মিত্র দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতে পরিণত হল সেই বিষয়েই দু-একটি কথা বলব।

আম্বেদকরের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে একটি অভিযোগ তোলা হয় এই বলে, যে তাঁর লক্ষ্য ছিল মার্কসবাদের শ্রেণি রাজনীতি থেকে দলিতদের পৃথক করে নিয়ে এক ধরণের পরিচয়ের রাজনীতি নির্মাণ করা। এখানে কমিউনিস্টরা ধরেই নেন, দলিতদের সংগঠিত করার অধিকার তাঁদের একচেটিয়া। কারণ দলিতরা শ্রমিকশ্রেণির অংশ। তাই কমিউনিস্টরা দলিতদের দলিত পরিচয় লোপাট করে শ্রেণি পরিচয়ের পতাকাতলে শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত করতে চান। একে তাঁরা মনে করেন শ্রেণি রাজনীতি। অর্থাৎ মুখে তাঁরা যা-ই বলুন বা দলিলে যা-ই লিখুন, দলিত শ্রমিকদের দলিত পরিচয় তাঁরা অগ্রাহ্য করেন। তাঁদের শ্রেণি রাজনীতিতে দলিত সংগ্রামের কোনো স্থান নেই। কারণ তাঁদের শ্রেণি রাজনীতির ধারণা ইউরোপ থেকে টোকা। অন্যদিকে আম্বেদকর মনে করেছেন দলিতদের দলিত পরিচয়ের পতাকাতলে দলিত সংগঠনে সংগঠিত করা দরকার। কারণ বর্ণব্যবস্থার উচ্ছেদ না ঘটাতে পারলে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশ গঠন করা যাবে না। কমিউনিস্টরা শ্রেণির ধারণাকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে বোঝার ফলে এবং ইউরোপীয় ধরনে বোঝার ফলে আম্বেদকরের বক্তব্য বুঝে উঠতেই পারেননি। উলটে অত্যন্ত আগ্রাসী ভিঙ্গিতে নিজেদের ভুল ধারণাকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। সুতরাং আম্বেদকরের রাজনীতিকে তাঁরা একপ্রকার বিভেদমূলক রাজনীতি এবং কালক্রমে “বিভেদমূলক ষড়যন্ত্র” বলে ধরে নিয়েছেন। আম্বেদকরও তার জবাব দিয়েছেন। ফলে গড়ে উঠেছে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, প্রতিযোগিতা, পরস্পরের কাজে অন্তর্ঘাত ইত্যাদি। উভয় পক্ষই এই আচরণ চালিয়ে গেছে। আর শাসক শ্রেণি এই কলহকে বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ এই বিবাদে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। তারা নিশ্চিন্তে থেকেছে। এই জটাজালেই ফেঁসে গেছে কমিউনিস্ট-আম্বেদকর সম্পর্ক।

পারস্পরিক কলহ আর শত্রুতার এই জাল থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে ভারতের কমিউনিস্টদের অবশ্যই ভারতীয় শ্রেণি বিভাজনের উৎপত্তি এবং শ্রেণিগুলির চেহারা সম্পর্কে নির্মোহ মূল্যায়ন থাকা দরকার ছিল। তা সেদিনও ছিল না, আজও নেই। এর জন্যে দরকার ছিল ভারতীয় ইতিহাসের সুগভীর অধ্যয়ন। যাকে বলে নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ। কিন্তু ভারতীয় কমিউনিস্টরা কখনোই তা করেননি। করলে কী দেখতে পেতেন? তাঁরা দেখতে পেতেন, যে ভারতে যাঁদের শূদ্র বলা হয়, দলিত বলা হয়, পিছড়ে বর্গ বলা হয় – তাঁরাই আসলে ভারতের কৃষক এবং তাঁদের মধ্যে থেকেই এসেছেন ভারতের শ্রমিক শ্রেণি। আমি এখানে কমরেড দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাইব। ঋগ্বেদের একটি সূক্তের দুটি ঋক্ আলোচনা করেছেন তিনি

পরস্পর বন্ধুত্বযুক্ত ব্রাহ্মণেরা যখন দ্রুত-মানস (মনসো জবেষুঃ দ্রুত চিন্তাক্ষমতার ইঙ্গিত হতে পারে) সহকারে তুষ্ট-হৃদয়ে সমবেত হন, তখন তাঁরা সেই (অজ্ঞ) বেদী-আহরণোন্মুখ ব্যক্তিকে দূর করে দেন এবং বেদজ্ঞানের চর্চা করেন।। ঋগ্বেদ ১০.৭১.৮

প্রশ্ন হল, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগোষ্ঠী এইভাবে (অজ্ঞ ব্যক্তি হিসাবে) যাদের দূর করে দেয়, তাদের শেষ পর্যন্ত কী গতি হয়? এ প্রশ্নের উত্তর হিসাবে আলোচ্য সূক্তেই একটি কথার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ইঙ্গিতটি হল, তারা কৃষক হিসাবে জমি চষতে যায় এবং তারাই “ তন্ত্র”-এর বিস্তার করে (তন্বতে তন্ত্রম্)। উপরোক্ত ঋকটির ঠিক পরের ঋকেই বলা হচ্ছে

এই যারা অর্বাচীন – যারা না পায় ব্রাহ্মণদের সঙ্গ, না দেবতাদের, না সোম-সেবনকারীদের, তারা পাপময় বাক্য সৃষ্টি করে এবং সিরীঃ হয়ে সেই অজ্ঞরা তন্ত্র বিস্তার করে (তন্বম্ তন্ত্রতে)।। ঋগ্বেদ ১০.৭১.৯

বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা যাদের অজ্ঞ বলে বেদী থেকে দূর করে দিল তারা সিরীঃ হয়ে গেল। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, সিরীঃ মানে কী? ঋগ্বেদ সংহিতায় শব্দটির নিদর্শন মাত্র এই একবারই পাওয়া যায় এবং আধুনিক বিদ্বানরা এর অর্থ সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হতে পারেননি। মনিয়র-উইলিয়ামস, কীথ, ম্যাকডোনেল প্রমুখ পণ্ডিতরা অনুমান করেছেন, সিরী বলতে বস্ত্রবয়নকারী বোঝানো অসম্ভব নয়, যদিও ওঁরা এই অর্থ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারেননি। কিন্তু উইলসন তর্জমা করেছেন, ploughman বা কৃষক। কিসের ভিত্তিতে করেছেন? মনে হয়, সায়ণ-ভাষ্যের ভিত্তিতে। কেননা, সায়ণাচার্য “সিরীঃ”-র অর্থ করেছেন “ সিরীণিঃ”, “সীর” মানে লাঙ্গল, সীরিণঃ- লাঙ্গলধারীগণ।” [দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ‘সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি’; অগ্রন্থিত রচনা/ অবভাস, ২০১০/ পৃঃ ৩১]

আরো পড়ুন মার্কিন দেশেও জাতের নামে বজ্জাতি করি আমরা

সুতরাং, আমাদের দেশের দলিত সম্প্রদায় – যারা আর্য সমাজের মধ্যেকার শূদ্র, বৈশ্যদের অধিকাংশ, এবং আর্য সমাজের বাইরের বিপুল অনার্য অধিবাসী – অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য, এবং অবর্ণ – এদের মিলিত যোগফলে তৈরি, তারাই এ দেশের জনসমষ্টির গরিষ্ঠ অংশ, তারাই আমাদের দেশের কৃষক এবং তাদের থেকেই এসেছে আমাদের শ্রমিকশ্রেণির এক বিরাট অংশ। ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে এবং ইউরোপিয় চশমায় ভারতেরও শ্রেণি বিচার করার ভ্রান্তির ফলে কমিউনিস্টরা এই সামান্য বিষয়টি বুঝতেই পারেননি। ফলে তাঁরা বোঝেননি, আম্বেদকর যখন দলিতদের নিয়ে পার্টি তৈরি করেন তখন তা একটি শ্রমিক পার্টি বা শ্রমিক-কৃষক পার্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। সে পার্টি ১৯৩৬ সালের ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি (ILP) বা ১৯৪২ সালের তফশীলি পরিষদ (SCF), যা-ই হোক না কেন। এ হল তর্কাতীত সত্য। ১৯৩৬ সালে ILP গঠনকে তাঁরা মোটেও ভাল চোখে দেখেননি। শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা হিসাবেই দেখেছিলেন। এর আগে ১৯২৯ সালে মুম্বাই টেক্সটাইলে ধর্মঘট নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার জ্বালা তো ছিলই।

উপরন্তু ভারতের কমিউনিস্টরা এও বুঝে উঠতে পারেননি যে, মার্কস এঙ্গেলস কখনো এমন ভাবেননি, যে এমনকি ইউরোপেও শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত করার মনোপলি একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিরই আছে। এমন ভাবনা একেবারেই শিশুসুলভ, অথবা হয়ত তত শিশুসুলভ নয়। এর পিছনে সম্ভবত কাজ করেছে ওই রহস্যময় পুরুষ ইগো। নইলে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, যা হাজার হাজার বার পড়া হয়েছে, তাতে বর্ণিত কথাগুলো কীভাবে কেউ খেয়াল না করতে পারে? কীভাবে এ কথা কেউ না বুঝতে পারে, যে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে নানা স্তর আছে, আছে চেতনার নানা মাত্রা? তাই শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে নানা ধরনের পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকশ্রেণির অন্যতম পার্টি, একমাত্র পার্টি নয়। তাই ইশতেহারে বলা হয়েছে

শ্রমিক শ্রেণির অন্যান্য পার্টিগুলির বিরুদ্ধ পৃথক পার্টি কমিউনিস্টরা গঠন করে না। সমগ্রভাবে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থ থেকে পৃথক এবং বিচ্ছিন্ন কোন স্বার্থ তাদের নেই। প্রলেতারীয় আন্দোলনকে রূপ দেওয়া বা গড়ে-পিটে তোলার জন্য তারা কোন নিজস্ব গোষ্ঠীগত নীতি খাড়া করে না।

শ্রমিক শ্রেণির অন্যান্য পার্টি থেকে কমিউনিস্টদের তফাতটা শুধু এই: ১) বিভিন্ন দেশের প্রলেতারিয়ানদের জাতীয় সংগ্রামে তারা জাতি-নির্বিশেষে সমগ্র প্রলেতারিয়েতের সাধারণ স্বার্থটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাকেই সামনে টেনে আনে। ২) বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির লড়াইকে যে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়, তাতে তারা সর্বদা এবং সর্বত্র সমগ্র আন্দোলনের স্বার্থটাকে তুলে ধরে।

সুতরাং কমিউনিস্টরা হল, একদিকে, কার্যক্ষেত্রে প্রতি দেশের শ্রমিকশ্রেণির পার্টিগুলির সর্বাপেক্ষা অগ্রসর এবং দৃঢ়চিত্ত অংশ – যে অংশ অন্যান্য সবাইকে সামনে ঠেলে নিয়ে যায়; অপরদিকে তত্ত্বের দিক থেকে, প্রলেতারিয়েতের বিপুল অংশের সঙ্গে তুলনায় তাদের এই সুবিধেটা আছে যে, প্রলেতারিয়ান আন্দোলনের এগিয়ে যাওয়ার পথ, পরিবেশ এবং আখেরী সাধারণ ফলাফল সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ বোধ রয়েছে।

কমুনিস্টদের আশু লক্ষ্য প্রলেতারিয়ানদের অন্যান্য পার্টির উদ্দেশ্য থেকে অভিন্ন: প্রলেতারিয়েতকে শ্রেণি হিসাবে গঠন করা, বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ, প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনীতিক ক্ষমতা জয়।

সুতরাং কমিউনিস্টরা এই যে শ্রেণি রাজনীতির কথা মুখে হাজারবার জপ করেছে, না বুঝেই, এবং তার নাম করে অসংখ্য ভুল কাজ করে গেছে, সেই শ্রেণি রাজনীতির প্রকৃত বিষয় হল শ্রমিকশ্রেণির অন্যান্য পার্টিগুলির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রমিকদের শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত করা এবং এক অভিন্ন সাধারণ লক্ষ্যে পরিচালিত করা। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্টরা শ্রমিকশ্রেণির অন্য অংশগুলিকে স্বীকৃতিই দিলেন না, বরং তাদের সাথে রেষারেষির সম্পর্কে এবং কালক্রমে শত্রুতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এক মহা সর্বনাশ সাধন করলেন।

শেষ পর্ব আগামীকাল

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

4 মন্তব্য

  1. Brhaminic communism is as bad as Hinduvta..West bengal is paradigm example of thse.. West bengal has apparently no caste politics..Dalits always voted for Three decade long communist (mis) rule. What is the result??? Dalits and tribals remain poorest ,most malnourished ,most illtterate, most ill-health population.

    • এই কথাটা বলুন….. আপনি কি অমর্ত্য সেনের “Capability” তত্ত্বকেও শোধনমূলক মনে করেন?? Dalits need share of ” Social capital” which will prevent them falling back into vicious circle of poverty and mathew effect. Sen’s ” Capbality” theory can only save Dalits. যদি আপনার মতলব থাকে আপনি ” নির্ভেজাল communusm” aka ” dicatorship of proletariat” বানাবেন তবে, sorry..We need nutrition-school and hispital…not romantic revolutionary poetry and big big theory of ” দন্দ্বমূলক বস্তুবাদ”, ” Anti-americanism”. Wr need to go to school college.. we wish to be professor, scholars ,thinkers, doctors , lawyers also..we do not need ” absolute equality”, but at least acess to school,hospital and nutritious food and ক্রয়ক্ষমতা to acess this..not just by govt -welfarism. We want liberal-democracy with progreseive constitutionalist politics.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.