প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতাকামী শক্তিগুলির সঙ্গে ইজরায়েলের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা পৃথিবী উত্তাল। অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নামছেন। যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে লন্ডন শহর। প্রতি সপ্তাহান্তে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিরাট মিছিল হচ্ছে সেখানে। লন্ডনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী কমিউনিস্টরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। বিশেষ করে যে দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ, সেই দেশগুলির কমিউনিস্টদের অনেকেই লন্ডন থেকে কাজ করেন। চলমান যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লন্ডনের ক্রয়ডনের রাসকিন হাউজে নাগরিক ডট নেটের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতা হল মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধির। ছিলেন প্যালেস্তাইন পিপলস পার্টি, লেবাননের কমিউনিস্ট পার্টি এবং ইরানের তুদে পার্টির নেতৃত্ব। নাগরিক ডট নেটের পক্ষ থেকে কথা বলেছেন অর্ক ভাদুড়ি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ফিরাস সারহান (প্যালেস্তিনিয়ান পিপলস পার্টি)
প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। একদম শুরুতেই আমি কথা বলে নিতে চাই প্যালেস্তাইন পিপলস পার্টির ফিরাস সারহানের সঙ্গে। কমরেড ফিরাস, আমি বুঝতে পারছি আপনি প্রবল মানসিক অস্থিরতার মধ্যে আছেন। আপনার প্রিয়জনরা গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে আছেন। আপনি যদি একটু বিশদে বলেন এই মূহূর্তে প্যালেস্তাইনের অবস্থা ঠিক কেমন? প্রতিরোধ, সংগ্রামই বা কী অবস্থায় আছে?
নাগরিক ডট নেটকে ধন্যবাদ। আমরা আমাদের কথাগুলো গোটা দুনিয়ার কাছে যত বেশি করে সম্ভব তুলে ধরতে চাই। মানবতার দোহাই, আমাদের পাশে দাঁড়ান। আমাদের শিশুদের পাশে দাঁড়ান।
প্রথমেই যেটা বলতে চাই, ভারতীয় জনগণের সঙ্গে আমাদের ফিলিস্তিনিদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমরা চিরকালই জেনে এসেছি ভারত আমাদের বন্ধু। আমি এখনই মনে করতে পারছি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর নাম। তাঁরা দৃঢ়ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, প্রথম নকবার সময়ে জওহরলাল নেহরুও আমাদের সমর্থন করেছিলেন। আমি জানি, ভারতীয় জনগণ, বিশেষ করে বামপন্থী এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানুষজন প্যালেস্তাইনের জাতীয় নেতা ইয়াসের আরাফতকে গভীর শ্রদ্ধা করেন। আপনার মাধ্যমে আমি ভারতীয় জনগণকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাতে চাই।
অর্ক, আমার ৫৫ বছর বয়স হল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরেছি, নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি খুব নরম মানুষ নই। আমি ইন্তিফাদায় লড়েছি। আমি জানি যে স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম খুব সহজ নয়। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘুমোতে পারছি না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। গোটা পৃথিবীর চোখের সামনে প্যালেস্তাইনের সন্তানদের হাজারে হাজারে হত্যা করা হচ্ছে। জাতিগতভাবে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। ইজরায়েল আমাদের পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে যা করার তাই করছে। এতখানি নৃশংসতা দেখেও তথাকথিত প্রথম বিশ্ব চুপ করে আছে! ভুল বললাম, তারা আসলে এই গণহত্যা স্পনসর করছে। আপনি ভাবতে পারেন, চার হাজারেরও বেশি শিশুকে ওরা খুন করেছে! একবার ভাবুন! আমরা প্রত্যেকে আমাদের পরিজনদের হারিয়েছি। আজ যার সঙ্গে ফোনে কথা হল, জানি না আগামীকাল সে জীবিত থাকবে কিনা। কিন্তু আমি একটা কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ওরা যদি ভাবে গোটা ফিলিস্তিনি জাতিকে খুন করে শেষ করে দেবে, তাহলে ওরা ভুল করছে। এভাবে আমাদের মোছা যায় না। আমরা লড়ব। প্রতিরোধ সংগ্রাম চলছে। কেবল গাজা নয়, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও আমরা লড়ছি।
পশ্চিমী দুনিয়া এই সংঘর্ষের জন্য হামাসকে দায়ী করছে…
প্রতিটি গণহত্যার জন্যই একটা অজুহাত খাড়া করতে হয়। হামাস তেমনই একটা অজুহাত। প্রথমত, যে হাজার হাজার শিশু খুন হচ্ছে, তারা কি হামাস? হাসপাতালে বোমা মারা হচ্ছে, উদ্বাস্তু শিবিরে বোমা মারা হচ্ছে, হাজার হাজার সিভিলিয়ান মারা যাচ্ছেন, তারা কি হামাস? আমি প্যালেস্তাইন পিপলস পার্টি করি। আমাদের সংগঠন প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা হামাসকে সমর্থন করি না। হামাসের সঙ্গে আমাদের সিরিয়াস রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং সংঘাত আছে। কিন্তু এই ঘটনার জন্য যাঁরা হামাসকে দায়ী করছেন, তাঁরা ইতিহাস আড়াল করতে চাইছেন।
আমরা চিরকালই জেনে এসেছি ভারত আমাদের বন্ধু। আমি এখনই মনে করতে পারছি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর নাম। তাঁরা দৃঢ়ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, প্রথম নকবার সময়ে জওহরলাল নেহরুও আমাদের সমর্থন করেছিলেন।
আপনার কি মনে হয় আদৌ এই ঘটনার সূচনা ৭ অক্টোবরে? একেবারেই না। বছরের পর বছর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজায় ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়ে আসছে ইজরায়েল। পাখি মারার মত করে মানুষ মারছে। কেবল গাজায় নয়, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও। আজ যদি হামাসই তাদের টার্গেট হয়, তাহলে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে কেন শয়ে শয়ে মানুষকে মারা হচ্ছে? সেখানে তো হামাস নেই। গত বছর, ২০২২ সালে, শুধু ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে দুই শতাধিক মানুষ খুন হয়েছিলেন। এবছরও প্রায় ২০০ মানুষ খুন হয়েছেন। গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক কার্যত উন্মুক্ত কারাগার। মোড়ে মোড়ে ইজরায়েলি চেক পোস্ট। প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের উপর সীমাহীন অত্যাচার চলে বছরের পর বছর ধরে। আর্ন্তজাতিক আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে ইজরায়েলের সশস্ত্র এবং অবৈধ দখলদার সেটলার কলোনিগুলি আমাদের জমি দখল করে রাখছে। এই বর্বরতা চলে আসছে বহু দশক ধরে। ওদের লক্ষ্য গোটা প্যালেস্তাইন দখল করা। আপনাকে বলছিলাম, গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এতদিন ছিল উন্মুক্ত কারাগার, এখন তা পরিণত হয়েছে উন্মুক্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। আমাদের উপর নেমে এসেছে দ্বিতীয় নকবা।
আপনি একটু আগে আপনার বাবার কথা বলছিলেন…
হ্যাঁ, আমার বাবার কাছ থেকে আমি ১৯৪৮ সালের প্রথম নকবার কথা শুনি। আমাদের, আরবদের সঙ্গে কোনোরকম পরামর্শ না করেই লক্ষ লক্ষ আরবকে বিতাড়িত করে, আমাদের জমিজমা ঘরবাড়ি সব কেড়ে নিয়ে ইজরায়েল নামে একটা নতুন দেশ তৈরি করে দেওয়া হল। ইজরায়েলের বেসরকারি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো তাণ্ডব চালাতে শুরু করল। প্ল্যান ডি বলে একটা প্রকল্প নিল, যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল আরবদের খুন করে, মেরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে উৎখাত করা। তারা সফল হয়েছিল। সাড়ে সাত লক্ষ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ফেলে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমার বাবার কাছ থেকে আমি যেমন সেই প্রথম নকবার কথা শুনেছি, আমার ছেলের সঙ্গে একযোগে তেমনই আমি এই দ্বিতীয় নকবার সাক্ষী থাকছি। আপনি কি জানেন, অর্ক, প্রথম নকবার সময়ে যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু শিবিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের অনেকেরই গোটা জীবনটা সেখানেই কেটে গেছে। তাদের আর ফেরা হয়নি। আমার গভীর সন্দেহ হচ্ছে, এই যে ইজরায়েল বলছে উত্তর গাজা খালি করে সেখানকার বাসিন্দাদের দক্ষিণ গাজায় চলে যেতে, এর আসল উদ্দেশ্যটা কী? ওরা কি আদৌ কাউকে আর উত্তর গাজায় ফিরতে দেবে? আমি জায়নবাদীদের বিশ্বাস করি না। সাড়ে সাত দশক ধরে একটু একটু করে ওরা আমাদের জমি জায়গা দখল করেছে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বিরাট এলাকা ওদের কবলে, ওরা কোনো আর্ন্তজাতিক আইন মানে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা জিতবে না।
এই সংঘর্ষের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে?
আমরা একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি নিশ্চয় জানেন, নয়ের দশকের শুরুতে অসলো চুক্তি হয়েছিল। ফিলিস্তিনিদের মতোই শান্তিকামী ইহুদিদের মধ্যেও সেই চুক্তি আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু প্রতিদিন সেই চুক্তিকে পদদলিত করেছে ইজরায়েল। দখলদারি এবং অত্যাচার ক্রমাগত বাড়িয়েছে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আগামী কয়েকটি সপ্তাহ বা মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি একটা দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তি পাব, এমন একটা চুক্তি যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে? নাকি আমরা, ফিলিস্তিনিরা এই ভয়াবহ নির্যাতনের মধ্যেই থাকতে বাধ্য হব? আমরা আরও বেশি সংখ্যায় উদ্বাস্তু হব, আমাদের ঠেলে ফেলা হবে সিনাই মরুভূমিতে বা নেগেভ মরুভূমিতে, ছুঁড়ে ফেলা হবে জর্ডনে? কিছুদিনের মধ্যেই এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে আপনি কী বলবেন?
আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় – এই শব্দবন্ধটা খুব মজার। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই শব্দবন্ধটা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ ব্যবহার করে অত্যাচারিতের বিরুদ্ধে, অত্যাচারীর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে। এবারও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার মিত্ররা একই কাজ করছে। কিন্তু সেটাই তো সব নয়। গোটা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ পথে নামছেন যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে। আসলে এটা তো কোনো যুদ্ধ বা সংঘর্ষ নয়, এটা গণহত্যা, একটা জাতিকে নির্মূল করে দেওয়ার চেষ্টা। গোটা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ বুঝতে পারছেন, এই সংঘাত ৭ অক্টোবর শুরু হয়নি। শুরু হয়েছে ৫৬ বছর আগে ১৯৬৭ সালে, যখন ইজরায়েল গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নিয়েছিল। ভুল বললাম। এই সংঘাত শুরু হয়েছে তারও আগে, ৭৫ বছর আগে, ১৯৪৮ সালে যখন প্রথম নকবায় আমরা উৎখাত হয়েছিলাম। না, এবারও ঠিক বললাম না। পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ এই সংঘাত শুরু করেছিল ১০৬ বছর আগে ১৯১৭ সালে, ব্যালফোর ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আমাদের বুক কেটে ইজরায়েল তৈরির চক্রান্তের সময়ে।
আপনাকে একটা কথা কেবল বলতে পারি, আমরা এই যুদ্ধে হারব না। আমাদের খুন করে শেষ করা যাবে না। আমরা লড়ছি আমাদের ইতিহাসের পক্ষে দাঁড়িয়ে। এই লড়াই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে যাবে। একথা ঠিক যে যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকত, এই সংগ্রামে আমাদের সুবিধা হত। কিন্তু লড়াই চলবেই।
নাদের আওয়াদ (লেবাননের কমিউনিস্ট পার্টি)
কমরেড নাদের, আপনি সদ্য বেইরুট থেকে লন্ডনে এলেন। লেবাননের পরিস্থিতি কেমন?
প্যালেস্তাইনের কমরেড যা বললেন, তারপর আমার আর খুব কিছু বলার নেই। আমি স্তব্ধ হয়ে ওঁর কথা শুনছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, গোটা আরব দুনিয়ার যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল, তখন আমরা তা পারছি না। না, আমি জনগণের কথা বলছি না। আরব জনগণের প্রতিটি অংশ প্যালেস্তাইনের পাশে আছে। আপনি নিশ্চয় দেখছেন গোটা মধ্যপ্রাচ্য মিছিলে মিছিলে উত্তাল। কিন্তু আমাদের শাসকশ্রেণির যে ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল তারা তা করছে না।
আপনি লেবাননের কথা জানতে চাইছিলেন। দেখুন, আমরা লেবানিজরা চিরকাল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে। ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের এই অবস্থান। আমি নিজে ১৬ বছর বয়সে পাথর হাতে রাস্তায় নেমেছিলাম প্যালেস্তাইনের সমর্থনে। আজও গোটা লেবানন ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংগ্রামে প্যালেস্তাইনের পক্ষে রয়েছে। বরং খানিকটা গর্ব করেই বলতে পারি, আমরা হয়ত পড়শিদের মধ্যে ফিলিস্তিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এর দুটো কারণ আছে। প্রথমত, আমাদের সঙ্গে প্যালেস্তাইনের নিবিড় যোগাযোগ। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের বিরাট অংশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির আধিপত্য আছে। আপনার নিশ্চয় সেই দুর্দান্ত ছবিটির কথা মনে আছে, যখন এডওয়ার্ড সঈদ লেবানন থেকে ইজরায়েলের দিকে পাথর ছুঁড়ছিলেন?
ইজরায়েল রাষ্ট্রকে আপনি মধ্যপ্রাচ্যের পক্ষে কতখানি সমস্যার বলে মনে করেন?
ইজরায়েল একটা সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র। তারা কেবল প্যালেস্তাইন নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্য দখল করতে চায়। বস্তুত, দুনিয়ার যে অংশে আমাদের বসবাস, সেখানে ইজরায়েলের সঙ্গে আরব (এবং অবশ্যই জায়নবাদবিরোধী ইহুদিদের) জনগণের বিরোধটাই হল মূল রাজনৈতিক প্রশ্ন। না, আমি শ্রেণির বিষয়টা অস্বীকার করছি না। একজন কমিউনিস্ট হিসাবে আমি মনে করি, এই সংগ্রামের কেন্দ্রে অবশ্যই শ্রমিকশ্রেণিকে থাকতে হবে, কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। কিন্তু মূল লড়াইটা জায়নবাদী ইজরায়েলের সঙ্গে।
ইজরায়েলের দখলদারির জন্য লেবাননও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু প্যালেস্তাইনের মত নয়। গত ২০ বছর ধরে গাজা কার্যত নরকে পরিণত হয়েছে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেরও সেই অবস্থা। আমি মনে করি, প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক মুক্তি এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন। সেই কবে থেকে আমরা মুক্ত ফিলিস্তিনের পক্ষে স্লোগান দিয়ে আসছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হল, বার্লিনের দেয়াল ভেঙে গেল, নেলসন ম্যান্ডেলা জেল থেকে বেরোলেন, ৯/১১ হল। কত কী বদলে গেল পৃথিবীতে, ফিলিস্তিনের যন্ত্রণার অবসান হল না।
হামাস একটি ইসলামিস্ট শক্তি। আপনাদের দেশের হিজবুল্লাও তাই। তাদের সম্পর্কে আপনাদের অবস্থান কী?
আপনি লেবাননের কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান জানতে চাইছেন তো? স্পষ্ট করে বলি, আমরা প্রতিরোধের পক্ষে। এটাই আমাদের অবস্থান। যে বীভৎসতা দশকের পর দশক ধরে ইজরায়েল চালিয়ে আসছে, তার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিরোধ করবেন, আমরা তাঁদের পক্ষে। কারণ আমরাও প্রতিরোধকারী শক্তি। এই প্রতিরোধ যদি কোনো মুসলিম বা খ্রিস্টান করেন, আমরা তাঁর পক্ষে। যদি কোনো বামপন্থী করেন, আমরা তাঁরও পক্ষে। প্রতিরোধ হল প্রতিরোধ।
আরো পড়ুন হামাস: অতীত থেকে বর্তমান, একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
লেবাননের হিজবুল্লা হল একটি প্রতিরোধকারী শক্তি। আমরা তাঁদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে কোনো অসুবিধা বোধ করছি না। হ্যাঁ, আমাদের সঙ্গে তাঁদের বিপুল মতপার্থক্য আছে, বহু বিষয় নিয়ে আমাদের সংঘাত হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু যখন ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা আসে, তখন আমরা ঐক্যবদ্ধ। এর মধ্যে ইসলামের কোনো ভূমিকা নেই। হিজবুল্লা ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়, আমরা তা চাই না। আমরা চাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে সংঘাত আছে এবং থাকবে। আমি একজন কমিউনিস্ট। আমি মদ্যপান করি, শুয়োরের মাংস খাই। ফারাক তো প্রচুর। সংঘাতের জায়গা অসংখ্য। কিন্তু জায়নবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা একযোগে প্রতিরোধের পক্ষে।
প্যালেস্তাইনের এই সংগ্রামের ভবিষ্যৎ কী বলে মনে হয়?
তারা অবশ্যই জয়ী হবে। যেমন করে ভিয়েতনাম জিতেছে। আমাদের ফিলিস্তিনি কমরেড যেমন বললেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যাবে স্বাধীনতার বোধ। মনে রাখবেন, হত্যা করে একটা জাতিকে খতম করা যায় না। আমরা লেবানিজ কমিউনিস্টরা এই সংগ্রামের পাশে থাকব।
হিজবুল্লা ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়, আমরা তা চাই না। আমরা চাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে সংঘাত আছে এবং থাকবে। আমি একজন কমিউনিস্ট। আমি মদ্যপান করি, শুয়োরের মাংস খাই। ফারাক তো প্রচুর। সংঘাতের জায়গা অসংখ্য। কিন্তু জায়নবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা একযোগে প্রতিরোধের পক্ষে।
নাভেদ সোমালি (আর্ন্তজাতিক সচিব, তুদে পার্টি, ইরান)
কমরেড সোমালি, আপনাদের দেশের সরকার কমিউনিস্টদের উপর বিপুল নির্যাতন নামিয়ে এনেছিল। অথচ প্যালেস্তাইনের প্রশ্নে তাদের এবং আপনাদের অবস্থান অনেকটাই এক।
একদম ঠিক বলেছেন। ইতিহাসে এমন কিছু বাঁক আসে, যখন পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিগুলো কোনো বিশেষ প্রশ্নে কাছাকাছি চলে আসে। ইরানের বর্তমান ইসলামিক শাসনে আমাদের তুদে পার্টি ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অজস্র কমিউনিস্ট খুন হয়েছেন। আমাদের দেশে তুদে পার্টিসহ সমস্ত কমিউনিস্ট কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। অত্যন্ত গোপনে আমরা দেশের ভিতরে কাজ করি। কিন্তু এখন আমরা চাই ইরানের সরকার সমেত মধ্যপ্রাচ্যের সবকটা দেশের সরকার প্যালেস্তাইনের পক্ষে দাঁড়াক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ইরানের যতখানি সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন, ততখানি সক্রিয় তারা নয়। যখন একটা জাতিকে নির্মূল করা চলছে, তখন বিবৃতির মাধ্যমে সংহতি জানানোর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল হাতে কলমে কিছু করা। ইরান বা তুরস্ক তেমন কিছু করছে বল আমি মনে করি না।
প্যালেস্তাইনের এই দীর্ঘকালীন দুরবস্থার জন্য পশ্চিম সাম্রাজ্যবাদ কতখানি দায়ী?
এই গণহত্যার দায় নিতে হবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার সহযোগী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের। তাদের প্রত্যক্ষ মদতে এই নিধনযজ্ঞ চলছে। জো বাইডেন থেকে ঋষি সুনক – প্রত্যেকের হাতে রক্তের দাগ। আসলে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে একের পর ষড়যন্ত্র, অভ্যুত্থান ইত্যাদির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে দেয়নি। সবটাই তারা করেছে নিজেদের অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে। যতদিন পর্যন্ত সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ছিল, ততদিন আর্ন্তজাতিকভাবে তারা চাপের মুখে থাকত। তবে যেভাবে দুনিয়ার রাজনৈতিক চিত্র বদলাচ্ছে, তাতে খুব বেশিদিন পশ্চিমীদের জারিজুরি চলবে না।
আজ থেকে ৩০ বছর আগে অসলো চুক্তি সই হয়েছিল। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ঈৎঝাক রাবিন এবং ইয়াসের আরাফতের উদ্যোগে। তারপর কী হল? বছর দুয়েকের মধ্যে রাবিন খুন হলেন। কে তাঁকে খুন করল? হামাস? পিএলও? কোনো মার্কসবাদী গেরিলা বাহিনী? না। খুন করেছিল জায়নবাদীদের সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল অংশ। এই ইতিহাস পশ্চিমের মিডিয়া তুলে ধরছে না।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সমেত আর্ন্তজাতিক মহলের এই মুহূর্তে কী করা জরুরি বলে আপনার মনে হয়?
জাতিপুঞ্জ কী করবে বা করতে পারবে আমি জানি না। তার আদৌ কিছু করার ক্ষমতা আছে বলেও আমার মনে হয় না। তবে বিশ্বের মানবিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল মানুষের উচিত ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুযায়ী স্বাধীন প্যালেস্তাইনের অস্তিত্ব যাতে প্রতিটি দেশ মেনে নেয়, সেই দাবি তোলা। এই স্বাধীন প্যালেস্তাইনের রাজধানী হিসাবে পূর্ব জেরুজালেমকে মেনে নিতে হবে। নকবা এবং তারপরেও ইজরায়েলের নির্যাতনে ঘরছাড়া হওয়া লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের ঘরে ফেরার সুযোগ এবং অধিকার দিতে হবে। এটা একদম প্রাথমিক কাজ।
ইজরায়েলের ভিতরেও একটি বড় অংশের মানুষ জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
অবশ্যই। আমাদের ইজরায়েলি বন্ধুরা সহস্র চাপের মুখেও প্রতিবাদ করছেন। কমিউনিস্টরা শাস্তির মুখে পড়ছেন। আসলে এই দমনের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৪৮ সালে গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের যে এলাকাকে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় প্যালেস্তাইনের জমি বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল, ১৯৬৭ সালে তা ইজরায়েল দখল করে নেয়। ইজরায়েলের ভিতরে যাঁরা এই দখলদারির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বা খানিকটা হলেও উত্তেজনা প্রশমিত করতে চেয়েছেন, তাঁদের উপরে হিংস্র আক্রমণ নামিয়ে এনেছে অতি দক্ষিণপন্থী জায়নবাদীরা।
আজ থেকে ৩০ বছর আগে অসলো চুক্তি সই হয়েছিল। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ঈৎঝাক রাবিন এবং ইয়াসের আরাফতের উদ্যোগে। তারপর কী হল? বছর দুয়েকের মধ্যে রাবিন খুন হলেন। কে তাঁকে খুন করল? হামাস? পিএলও? কোনো মার্কসবাদী গেরিলা বাহিনী? না। খুন করেছিল জায়নবাদীদের সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল অংশ। এই ইতিহাস পশ্চিমের মিডিয়া তুলে ধরছে না। জায়নবাদীরা যে আদতে শান্তি চায় না, তারাই যে ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে রেখেছে, সেকথা বলছে না পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম।
আরেকটি কথা আমি বলতে চাই। ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আমাদের বারবার বলতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে কেমন করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ। ইরানে ১৯৫৩ সালে মহম্মদ মোসাদ্দেগ সরকার উচ্ছেদের কথাই যদি ধরি, তাহলেই দেখব ওদের কখনোই মধ্যপ্রাচ্যে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সহ্য হয়নি। ওরা চেয়েছে ওই এলাকায় অস্থিরতা বজায় রাখতে। এই কাজে ওদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র ইজরায়েল। তাই প্যালেস্তাইনের সংগ্রাম আমাদের প্রত্যেকের সংগ্রাম, গোটা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। প্যালেস্তাইনের পক্ষে দাঁড়ানো মানে আসলে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।