বিহারে হঠাৎ পট পরিবর্তন। বিজেপিকে অস্বস্তিতে ফেলে জনতা দল ইউনাইটেড নেতা এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার পদত্যাগ করলেন। বিরোধী জোটের সদস্যরা, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জনতা দল, কংগ্রেস এবং বাম দলগুলো নীতীশকে সমর্থন জানাল। হিন্দি বলয়ের রাজ্য বিহার দেশজুড়ে অনেককেই চমকে দিল। এই রাজনৈতিক পালাবদল নিয়ে নাগরিক ডট নেটের সঙ্গে কথা বললেন বিহারের সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া বাম দল সিপিআইএমএল লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
দীপঙ্করদা, বিহারের সাম্প্রতিকতম ঘটনাবলীতে আপনি দৃশ্যতই খুশি। কিন্তু এতবার শিবির পালটানো নীতীশের কি আদৌ কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা আছে?
হ্যাঁ, আমরা নিঃসন্দেহে খুশি। বিজেপি বিহারকে তার সাম্প্রদায়িক হিংসার নতুন পরীক্ষাগার তৈরি করতে চেষ্টা করছিল। এই ঘটনায় সেই প্রচেষ্টা বেশ খানিকটা ধাক্কা খাবে। পাশাপাশি মহারাষ্ট্রে তারা যা করল, বিহারে তার খানিকটা জবাবও পেল। ফলে খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু নিশ্চিন্তির কোনো অবকাশ নেই। আমাদের কাজ হল বিহারের বিজেপিবিরোধী জনতার মধ্যে যথাসম্ভব বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা, সেই ঐক্যকে সংহত করা। বিজেপির ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সর্বাত্মক প্রতিরোধ করা। গণআন্দোলনগুলির সঙ্গে বিরোধীদের ঐক্য গড়ে তোলা। এই কাজগুলির ক্ষেত্রে খানিকটা সুবিধা তো হল বটেই। বিহার কিছুটা আশার আলো বলা যায়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
নীতীশ কুমার এখন অত্যন্ত দুর্বল। জেডিইউ ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। ওঁর বিশ্বাসযোগ্যতা আছে কি নেই, সেটিকে আমরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছি না। নীতিশ বস্তুত শেষের মুখে। ওঁর কাছেও ক্রমশ সব রাস্তাই বন্ধ হচ্ছে। আবারও বিজেপির জোটে ফিরে গেলে আরও শোচনীয় অবস্থা হবে ওঁর। উনি অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। মনে হয় না সেটা করতে যাবেন।
নীতীশ হঠাৎ এমন ভোলবদল করলেন কেন, কী মনে হয়?
হঠাৎ একেবারেই নয়। এমনটা হওয়ারই ছিল। বহুদিন ধরেই জমি তৈরি হচ্ছিল। বিজেপি বিহার সহ গোটা দেশেই তার রাজনৈতিক আগ্রাসন বাড়াচ্ছে। এই ঘটনা সেই আগ্রাসী রাজনীতির লজিকাল ফলাফল। বিজেপি প্রথমে বলল, কংগ্রেসমুক্ত ভারত। তারপর এক এক করে অ্যাক্টিভিস্টদের জেলে ঢোকাল। এরপর শুরু হল একটার পর একটা বিজেপিবিরোধী সরকারকে ভাঙা, বিরোধী বিধায়কদের কেনা, ইডি দিয়ে বিরোধীদের হেনস্থা করা। এইরকমভাবে এগোচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপি আরও আত্মবিশ্বাসী। সে এখন নিজের শরিকদেরও আর কোনো জায়গা দিতে চায় না। গত ৩০-৩১ জুলাই পাটনায় গেরুয়া শিবির একটি বড় সাংগঠনিক বৈঠক করেছে, তাতে সংঘ পরিবারের প্রায় সব গণসংগঠন ছিল। জেপি নাড্ডা উপস্থিত ছিলেন। তিনি খোলাখুলি বলেন, ‘আঞ্চলিক দলের দিন শেষ। খুব দ্রুত দেশে একটিমাত্র দল থাকবে, সেটি বিজেপি’। বিহারে এই মন্তব্যের প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া, অমিত শাহ ইদানীং সবসময় বলেন, আগামী ৩০-৪০ বছর বিজেপি দেশ শাসন করবে। অর্থাৎ বিজেপির পাখির চোখ হল, আগামী চার দশকের জন্য দেশে কার্যত একদলীয় শাসনের ভিত তৈরি করা।
আমার মনে হয়, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের পর বিহারে বিজেপি দ্রুত হাঁটছিল, তার আগ্রাসনের গতি বাড়াচ্ছিল। একটা ছোট পার্টি ভিআইপি। তারা বিজেপির জোটসঙ্গী ছিল। বিজেপি তাদের নিজের সঙ্গে মার্জ করিয়ে নিল। ভিআইপির তিনজন এমএলএ ছিলেন, বিজেপি সকলকেই নিজেদের দলে ঢুকিয়ে নিল। একজন এমএলসি মন্ত্রী ছিলেন, তাঁর মন্ত্রিত্ব কেড়ে নিল। এবার তাদের বর্শামুখে পড়ার কথা জেডিইউয়ের। বহুদিন ধরেই তারা জেডিইউকে নানা ভাবে আক্রমণ করছে। সাংগঠনিক জায়গায় আঘাত করছে, দল ভাঙাচ্ছে।
আরো পড়ুন রিসর্ট রাজনীতি থেকে ভারত দর্শন রাজনীতি: মহারাষ্ট্র যা দেখাল
নীতীশ বিজেপির বহুদিনের শরিক। অন্যতম পুরনো জোটসঙ্গী। তিনিও অনুভব করছেন কী হতে চলেছে। শিবসেনা আর জেডিইউ হল বিজেপির দুই পুরনো শরিক। শিবসেনা আদর্শগতভাবেও বিজেপির কাছাকাছি। তারা বিরোধিতা করায় বিজেপি তাদের সঙ্গে কী করল, নীতীশ সেটা দেখেছেন৷ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাঁর আর কিছু করার ছিল না। আসল বিষয় হল, বিজেপির আগ্রাসনের সামনে নীতীশ বহু দেরিতে হলেও তাঁর জায়গা থেকে একটা প্রতিরোধ করলেন। উনি নামেই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এতদিন৷ আসলে ছিলেন বিজেপির দয়ার উপর নির্ভরশীল। উনি ভেবেছেন, আমাদের সঙ্গে এলে খানিকটা বেশি স্পেস পাবেন। দমবন্ধ অবস্থা একটু কাটবে।
বিহার এবং তার আশেপাশে এর কী প্রভাব পড়বে?
বিহারে তো খুবই জোরদার প্রভাব পড়বে। বিজেপির জন্য বড় ধাক্কা তো বটেই, সেই সঙ্গে হিন্দি বলয় জুড়েই এর অভিঘাত তীব্র হবে। বিজেপি যেভাবে এসসি, মহাদলিত, অতি পিছড়াসহ গোটা সোশাল জাস্টিস শিবিরের মধ্যে বিরাট প্রভাববলয় গড়ে তুলেছে, তার নেপথ্যেও নীতীশের সঙ্গে জোটের ভূমিকা আছে। বহু বছর ধরে একটু একটু করে বিজেপি এই জায়গা করেছে। নীতীশের এই অংশের উপর যে প্রভাব, বিজেপি তাকে ব্যবহার করেছে। যে কোনো কারণেই হোক, নীতীশ এখন সে জায়গা থেকে সরে এলে ভালই হবে। মনে রাখতে হবে, উনি এখন অনেক দুর্বল। তাঁর আগের যে ‘অরা’ ছিল, তথাকথিত গুড গর্ভন্যান্স, উন্নয়ন, ক্ষমতায়নের উপর ভিত্তি করে যে প্রভাব ছিল, তার অনেকটাই বিজেপি ছিনিয়ে নিয়েছে। তা সত্ত্বেও নীতীশ বড় নাম, সমাজবাদী ঐতিহ্যের অংশ। তিনি বিজেপির হাত ছাড়লে সেটা নিঃসন্দেহে সার্বিকভাবে ভাল হবে। জিতনরাম মাঝিও বিজেপির থেকে সরে এলেন। উত্তর ভারতের রাজনীতিতে এখনও সোশাল ফ্যাক্টরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এরা বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ালে একটা বৃহত্তর সোশাল ব্যারিকেড তৈরি হতে পারে বিজেপির বিরুদ্ধে। বিরোধীরা সার্বিকভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে।
আপনারা কি সরকারে যাবেন?
আমরা, সিপিআইএমএল লিবারেশন, সরকারে যাব না। আমরা একটা কো-অর্ডিনেশন তৈরি করার চেষ্টা করব। সরকারে যাওয়াটাই বিজেপিবিরোধিতার একমাত্র রাস্তা নয়। মনে রাখতে হবে, বিজেপির হিংস্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশে বিরাট সিভিল সোসাইটি আন্দোলন আছে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন আছে। জনতার লড়াই আছে। আপনি জানেন, আমরা বিহারের গণআন্দোলনের ঐতিহ্য বহন করি। মা-লে আন্দোলনরত জনতার দল বলেই পরিচিত। আমরা এই লড়াই, সংগ্রামেরই প্রতিনিধিত্ব করি। আমরা সেভাবেই থাকব। আমাদের কাজ হবে সরকারের উপর নজরদারি করা। যে সব অ্যাজেন্ডা নিয়ে মহাগঠবন্ধন নির্বাচনে গিয়েছিল, তার বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করা। সেই সঙ্গে নীতীশ কুমার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলিও বাস্তবায়িত করতে চাপ দেওয়া।
বিহারে আপনাদের এতজন বিধায়ক, এত বছরের সংগ্রামের পর এই প্রথম আপনারা সরকারে যাওয়ার জায়গায় আছেন। ক্যাবিনেটে গেলে পলিসি মেকিং সংক্রান্ত বিষয়ে সুবিধা হত না?
আমরা মনে করি না সরকারে গেলে খুব বেশিকিছু করে ফেলতে পারব। বরং বিরোধী পরিসরের পুরোটা যাতে বিজেপি খেয়ে না নেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এমনিতে নীতীশ কুমারই তো মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। আপনি সাক্ষাৎকার শুরুই করলেন বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন দিয়ে। নীতীশজি আগামীতে কী করেন, সেটাও নজরে রাখতে হবে। আমরা গণআন্দোলনের পার্টি, রাজপথের পার্টি, আমরা সেখানেই থাকব। আমাদের দায়বদ্ধতা থাকবে সরকারের প্রতি। সরকার যাতে আমাদের জন্য না পড়ে যায়, আমরা সেটা নিশ্চিত করব। বিজেপিকে সরকার থেকে দূরে রাখব। কিন্তু ক্যাবিনেটে যাওয়ার দরকার নেই।
বাকি বামদলগুলি কি সরকারে যাবে?
আমি কেবল আমাদের কথাই বলতে পারি। সিপিএম, সিপিআইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়নি এই বিষয়ে।
নতুন সরকারের উপর আপনি যে নজরদারির কথা বলছেন, সেটা ঠিক কীরকম?
বিহারের পরিস্থিতি ভালো নয়। অপরাধের গ্রাফ উঠছে, সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাড়ছে। বিজেপি কার্যত তার সাম্প্রদায়িক হিংসার নতুন পরীক্ষাগার করতে চাইছে বিহারকে। সরকারকে সেসব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মহাগঠবন্ধন কিছু অ্যাজেন্ডার ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল। ২০২০ সালের বিহার নির্বাচন জাতপাতের প্রশ্নকে পিছনে ঠেলে বেরোজগারি সহ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে সামনে এনেছিল। আপনি জানেন, যে অ্যাজেন্ডার কথা বলে মহাগঠবন্ধন বিধানসভা নির্বাচনে গিয়েছিল, তা তৈরিতে আমাদের ভূমিকা ছিল
অনেকটাই। তার বাস্তবায়ন জরুরি। নীতীশজিও যে উন্নয়ন ও সুশাসনের কথা বলেন, তা হাতে কলমে করে দেখাতে হবে। আমরা বাইরে থেকে সেটাই খেয়াল রাখব।
২০২৪ সালের আগে এই পটপরিবর্তন কি বিহারে বামেদের বেশি লোকসভা আসনে লড়ার সম্ভাবনা খর্ব করল? আরজেডি, কংগ্রেসের পাশাপাশি এখন তো জেডিইউও বিরোধী জোটের অংশ।
২০২২ সালের ভারতে দাঁড়িয়ে আমরা দুটো কথা বলছি। এক, বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিরোধী ঐক্য। দুই, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলির সঙ্গে সংসদীয় বিরোধীদের যোগাযোগ নির্মাণ। বিজেপিকে হারাতে এই দুটি খুব জরুরি। দ্বিতীয়টা একেবারেই হচ্ছে বলে মনে হয় না। সেই কারণেই বিরোধীদের অত্যন্ত দুর্বল, নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে। দেখা যাক এই সমস্যা কাটাতে বিহার কী ভূমিকা নেয়।
বামেদের কথা সার্বিক ভাবে আমার বলাটা ঠিক নয়। আমি আমাদের কথা বলতে পারি। আমরা ২০১৯ সালের লোকসভায় মাত্র একটা সিটে লড়েছিলাম। ২০২০ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ১৯ সিটে লড়ি। সকলেই দেখেছেন আমাদের স্ট্রাইক রেট কেমন ছিল। এবার ২০২৪ সালে কী হবে, কত আসনে লড়ব এসব তখন ঠিক হবে। আমরা আপাতত নিজেদের আশু লাভের কথা ভাবছি না। আমাদের পাখির চোখ বিজেপিকে আটকানো। দেশটাকে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের ল্যাবরেটরি তৈরির হাত থেকে বাঁচানো। বিহারের সাম্প্রতিকতম পটপরিবর্তন এই কাজটায় সহায়ক ভূমিকা নেবে।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।