শুভাশীষ মোদক চৌধুরী
স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে অনেকদিন ধরেই চারদিকে নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা চলছে। প্রধানমন্ত্রীও কদিন আগে তাতে যোগ দিয়েছেন এবং দেশবাসীকে বাড়িতে এবং সোশাল মিডিয়ায় জাতীয় পতাকা টাঙাতে বলেছেন। থালা বাজানো অথবা সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর মতই ওই কাজদুটোও দেশপ্রেমের প্রকাশ হয়ে উঠেছে। প্রতি বছরই এমন কিছু হুজুগ আসে এবং চলে যায়। কিন্তু এবারের হুজুগ এই দূর দেশে বসেও সোশাল মিডিয়ার দৌলতে ভালই অনুভব করছি। আর এই সূত্রেই জাতীয় পতাকা নিয়ে নিজের একটা বহু পুরনো অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল।
সময়টা ডিসেম্বর ২০০৫ থেকে জানুয়ারি ২০০৬। মুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনের এক দশক পরে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বৃদ্ধির হার তখন ৭%-৮%। ‘আচ্ছে দিন’ বা ‘স্বচ্ছ ভারত’ এর পূর্বসুরী ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ বিদায় নিয়ে এসেছে প্রথম ইউপিএ সরকার, যারা দেশ চালাতে শরিকদের উপর খুবই নির্ভরশীল। সংসদে সবে পাস হয়েছে কাজের এবং রোজগারের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (MGNREGA)। ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় লোকের কম, কারণ হাতে কাজ আছে, কাজ আসছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আমি অবশ্য দেশে ছিলাম না, গবেষণা করতে আমেরিকা পাড়ি দেওয়ার পর সেই প্রথমবার বাড়ি গিয়েছি। আরেক প্রবাসী বাঙালি বন্ধুর সাথে যুক্তি করেছিলাম, কলকাতাতে যাওয়ার টিকিটের (ছাত্র হিসাবে) যেহেতু অনেক দাম, সেহেতু প্লেনে দিল্লি অবধি যাব, আর বাকিটা ট্রেনে। আর ফেরার সময় সরাসরি আমাদের গন্তব্যে না ফিরে দিল্লিতে দুদিন থেকে শহর এবং তাজমহল দেখব, তারপর যে যার মত প্লেন ধরে ফিরে যাব।
সেইসময় খুব বুদ্ধির কাজ মনে হলেও, পরে বুঝেছি অল্প কদিনের ছুটিতে ওইভাবে ঘুরে বেড়ানো আর হয়ে ওঠে না। বাবা-মা, আত্মীয়, প্রতিবেশী সবাই অপেক্ষা করে থাকেন। বিদায় নেওয়ার সময় নিজেরই খুব খারাপ লাগে – কেন আরও কয়েকদিন থাকলাম না। সে আরেক আলোচনা। প্রাসঙ্গিক কথাটা হল, ফেরার আগে সেই দুদিন দিল্লি-আগ্রা ঘুরব বলে আমি আর আমার বন্ধু ড্রাইভার সমেত একটা গাড়ি ভাড়া করি। ড্রাইভার ছেলেটা (ছেলেই বলব, কারণ তখন তার বয়স সম্ভবত কুড়িরও নীচে) আমাদের দিল্লির টুরিস্ট স্পটগুলো, অলিগলি, খাবার জায়গা, আগ্রায় তাজমহল এবং আশেপাশে যা আছে সব ঘুরিয়ে দেখায়। সাবলীলভাবে দায়িত্ব নিয়ে কোনটার পর কোনটা দেখব নিজেই ঠিক করে দেয়। তার সাথে প্রচুর আড্ডাও হয়েছিল। কোন ধাবায় শস্তায় ভাল খাওয়া যায়, কোন সময়ে জ্যাম কম হয় ইত্যাদি। আমাদের শিশুর বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আমেরিকা ঠিক কীরকম? রাস্তায় গর্ত নেই? আফসোস করেছিল, ‘দিল’-এর শহর দিল্লিতে দেড়দিনে আমরা কিছুই দেখতে পারলাম না।
পরদিন আমার বন্ধু চলে গেলেও দিল্লির অন্যান্য বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে আমি একদিন বেশি থেকে যাই। যেহেতু এই কদিন চেনাজানা হয়ে গিয়েছিল, আমি বুঝেছিলাম যে ড্রাইভার ছেলেটি নির্ভরযোগ্য। আমার প্লেন ছিল সকাল সাড়ে সাতটায়, তাই সাড়ে চারটের মধ্যে এয়ারপোর্ট যেতে হবে। এয়ারপোর্ট যাওয়ার সময় আমি ওই ছেলেটিকেই ট্যাক্সি নিয়ে আসতে বলি। খুব ভোরবেলা, রাস্তা ফাঁকা, দিল্লির শীতকালের কুখ্যাত বায়ুদূষণ তখনো জেঁকে বসেনি, বৃষ্টি পড়ছিল। ছেলেটির পাশের সিটে বসে আরও বেশকিছু কথা হয়। সে আমায় জিজ্ঞেস করে বাড়ি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে থাকতে কেমন লাগে। আমি উত্তর দেওয়ার আগেই সে বলে, কাজ করতে দেশ (দেশই বলেছিল, গ্রাম নয়) ছেড়ে এসে তার ভালো লাগে না। আমি জিজ্ঞেস করি সে কী করতে চায় এরপর। সে বলে আরও পড়বে, বড় হবে, “সরকারি সাহিব” হবে। যদি না-ও হতে পারে, সরকার তো চেষ্টায় সাহায্য করবে বলেছে।
আমি অর্থনীতির ছাত্র। সরকারের উপর মানুষের এত বিশ্বাস, নিজের অন্যান্য সত্তা ভুলে সরকারকে বিশ্বাস করে একজন নাগরিক হিসাবে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার এই নিষ্ঠা আমি আগে দেখিনি। তাই শুধু একজন মানুষ হিসাবে নয়, অর্থনীতির ছাত্র হিসাবেও ছেলেটার লক্ষ্য এবং বিশ্বাস আমায় খুশি করেছিল। গবেষণার কাজে সরকার বা অন্য কর্তৃপক্ষের সুনাম (বা দুর্নাম) সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা রিসার্চ পেপার পড়ার আগেই ওকে দেখে শিখেছিলাম।
আমি ওকে বলছিলাম প্রথমবার ফেরার সময় দিল্লির আলোগুলো দেখে কীভাবে প্লেনের জানলার কাছে ঘেঁষে বসেছিলাম (আজও হয় ফেরার সময়), কীভাবে বাবা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে, পুজোর সময় দেশে ফেরার ইচ্ছে ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় কথা।
ছেলেটার গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ওপরে ছিল ছোট্ট একটা কাগজের তৈরি জাতীয় পতাকা। বলেছিল, সবসময় ওটা সঙ্গে রাখে, কারণ ও আরও বড় হতে চায়, ভাল কিছু করতে চায়। দেশের জন্য ভাল কিছু করতে, কিন্তু সেটা জোরে বলা বারণ। সঙ্গে অনাবিল হাসি। আমি কী বলব বুঝতে পারিনি, কারণ এয়ারপোর্ট এসে পড়েছিল। তবে এয়ারপোর্টে নেমে ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে সুটকেস নিয়ে চলে যাওয়ার আগে ও আমায় সেই পতাকা দিয়েছিল। বলল, ভাইসাব দেশকে মনে রাখবেন, আর আমাদের। আমি দাম দিতে চাইতে মুখের চেহারা এমন হল যে কিছু বলতে পারিনি।
সেই পতাকা প্রায় ১২ বছর ধরে আমার কাছে, আমার অফিস ডেস্কের পাশেই থাকত – প্রথমে আমেরিকা, তারপর ব্রিটেনে। ২০১৭ সালে যখন শহর বদল হল, দেখলাম মুভিং কোম্পানির লোকজন প্যাক করতে গিয়ে প্রায় ছিঁড়েই ফেলেছে। ওটাকে বদলাতে হত, তবু সে বছরের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ওই পতাকা দিয়েই চলল।
আরো পড়ুন কর্পোরেটতান্ত্রিক ভারতে প্রতিবাদী মানেই দেশদ্রোহী
প্রথামত যখন একা একা ওই ছেঁড়া পতাকা বাগানে পুড়িয়ে দিচ্ছি, তখন ওই ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ছিল। ও কি জানে পতাকাটা এতদিন ছিল? আরও পরে আজ ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে — ও যা করতে চেয়েছিল তা কি করতে পেরেছে? ওর বাড়ি কি এখনও আছে? বেঁচে আছে তো ছেলেটা?
ছেলেটা নামধাম বলেছিল, আমি আমার উন্নাসিকতায় পুরোপুরি মনে রাখিনি। যেটুকু মনে আছে, উত্তরপ্রদেশের গ্রামের ছেলে, বড় হতে চায়, মনে করে ও বড় হতে পারবে, সমাজ ওকে বড় হতে দেবে। নাম আশরফ বা আশফাক। ঠিক মনে নেই।
লেখক ইংল্যান্ডের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।