দেবজিৎ ভট্টাচার্য
ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক জনসভায় আদিবাসী জনজাতির মন রক্ষার্থে তাদের ভাষায় দেওয়া ভাষণ আর রাতের অন্ধকারে দক্ষিণ বস্তারে আদিবাসীদের বসতি এলাকায় আকাশ থেকে বোমা নিক্ষেপ এক নগ্ন, নির্লজ্জ দ্বিচারিতা। এর ফলে আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ আরো পিছিয়ে পড়ছে। বিদ্রোহী আদিবাসী জনজাতির মানুষকে বোকা ভাবা ভারত সরকারের সবথেকে বড় মূর্খামি। আদিবাসী মানুষের থেকে বাস্তবে দূরে সরে থেকে নতুন ভারত গড়ার ডাক দেওয়া ভারত সরকারের ভাঁড়ামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আদিবাসীরা প্রথম থেকেই দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, দুরকম শত্রুর বিরুদ্ধেই লড়েছে, যা দেশের অধিকাংশ মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে সাহায্য করেছে। আদিবাসীদের লড়াকু ইতিহাস দেখলেই কথাটা স্পষ্ট হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
১৭৮০ সালে সাঁওতাল জননেতা তিলকা মাঞ্জির নেতৃত্বে আদিবাসী মানুষের বিদ্রোহের সূচনা। তিনি সর্বপ্রথম ‘সাঁওতাল মুক্তিবাহিনী’ গঠন করে পাঁচ বছর ধরে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম চালনা করেন। ১৭৮৫ সালে বিদ্রোহী তিলকার ফাঁসি হয়। কিন্তু এই বিদ্রোহের আগুন আদিবাসীদের মধ্যে দাবানলের গতিতে ছড়াতে থাকে। পরবর্তীকালে মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমেই ১৮১১ সালে আদিবাসীরা আবার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম গড়ে তোলেন। ১৮২০ সালে তৃতীয়বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থবার আদিবাসী গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
অবশেষে ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়। সিধু মুর্মু, কাঁহু মুর্মু এবং দুই ভাই চান্দ ও ভাইরোর নেতৃত্বে। তারা নিজেদের গ্রাম ভগনাডিহিতে সুদখোর মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ এবং ব্রিটিশ শাসকের নিপীড়ন, অত্যাচারের হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্তির লক্ষ্যে এক বিশাল রাজনৈতিক সমাবেশের ডাক দেন।
সেইসময় সর্বত্র মহাজনরা ঋণের ফাঁদ পেতে সাঁওতালদের সর্বস্ব গ্রাস করে নিত। এমনকি স্ত্রী এবং সন্তানদেরও সম্পত্তি হিসাবে তুলে দিতে হত দাদন ব্যবসায়ী আর মহাজনদের হাতে। ব্রিটিশ পুলিশের সহায়তায় তাদের গবাদী পশু কেড়ে নেওয়া হত। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই বন্দী করা হত। ফলত দানা বাঁধে ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ। ৩০ জুন ৩০ হাজারের বেশি আদিবাসী মানুষকে নিয়ে সমাবেশ এবং কলকাতা দখলে গণযাত্রা (লং মার্চ) করেন সিধু, কাঁহুরা। ভারতীয় উপমহাদেশে সেটাই রাজনৈতিক গণসংগ্রামের সূচনাবিন্দু বলা যায়। এই ৩০ জুনই আজকের আদিবাসী-ভারতে ‘হুল দিবস’ নামে পরিচিত।
এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে বিদ্রোহী সাঁওতাল নারী ফুলো মুর্মো ও ঝানু মুর্মু ছিলেন সাঁওতাল নারী বাহিনী নিয়ে। ব্রিটিশ পুলিশ ফুলোকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তার লাশ রেললাইনে ফেলে দেয়। আদিবাসী সমাজে আজও এই দুই নারীর শহীদ দিবস পালন করা হয় এবং এঁরাই প্রথম বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়েছেন আসিবাসী মনে।
৩০ জুনের পদযাত্রা থেকে সাতজন সাঁওতাল নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিস সিধু, কাঁহু’কে গ্রেফতার করতে উদ্যত হলে বিক্ষুদ্ধ সাঁওতাল বিদ্রোহীরা পাঁচকাঠিয়া বলে একটা জায়গায় সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অত্যাচারী মহাজন কেনারাম ভগত, দারোগা মহেশলাল দত্ত সহ আরও ১৯ জন মারা যায়, বিদ্রোহ আরও গতি পায়; ব্রিটিশ শাসকের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২১ জুলাই কাতনা গ্রামে ব্রিটিশ বাহিনী সাঁওতাল বিদ্রোহীদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। জুলাই মাসেই বিদ্রোহীরা বীরভূমের ব্যবসাকেন্দ্রিক নাগপুর বাজার ধ্বংস করেন। ওই বাজারে তাঁদের উপর মহাজন, দাদন ব্যবসায়ী আর ব্রিটিশ পুলিশ একত্রে অত্যাচার করত।
১৭ আগস্ট ব্রিটিশ সরকার আত্মসমর্পণের ঘোষণাপত্র প্রচার করলে বিদ্রোহী সাঁওতালরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। সরকার অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিধু-কাঁহুর বিরুদ্ধে ‘অস্বা সামরিক আইন‘(অস্ত্রবহনে নিষেধাজ্ঞা) জারি করে। কিন্তু গণসংগ্রামের চাপে ১৮৫৬ সালের ৩ জানুয়ারি তা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সিধু শহীদ হন এবং ভিতরের লোক মারফত কাঁহুর খোঁজ পেয়ে পুলিস তাঁকে গ্রেফতার করে পরের সপ্তাহে। কালবিলম্ব না করে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। এই বিদ্রোহের ধারাবাহিকতাতেই ভারতে পরবর্তী যুগে হয়েছে তেভাগা-তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি, ডেবরা গোপীবল্লভপুর-বহরাগোড়া, লালগড় বা আজকের ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তিশগড়ের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম।
বর্তমান ভারতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মোট ১০ কোটি মানুষ পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, অসম প্রভৃতি রাজ্যে বসবাস করছেন। এঁরা ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮.৬%। আদিবাসীদের মধ্যে ৮৭% মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে জল-জমি-জঙ্গলভিত্তিক চাষাবাদের উপর।
আদিবাসী-ভারতে “ঝাড়খণ্ডী” আন্দোলন তাদের সমাজ, ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্বজ্ঞানের পরিচায়ক। এই আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে দুটো পৃথক সমাজব্যবস্থার লড়াই। এখনো আদিবাসীরা মনে করেন, এ লড়াই ছিল বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ভূমিপুত্রদের লড়াই।
আমাদের প্রথমেই বোঝা দরকার যে ঝাড়খণ্ড নামটার মধ্যে যে সরলীকৃত ভাবনা আছে (জঙ্গলের অঞ্চল) তা অনাদিবাসী ভাবনা। আদিবাসী সমাজের ভাষা-সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতেই এই ভাবনাকে বহন করা হচ্ছে। ‘জাহের থান’ হল এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। জাহের মানে সাঁওতাল বা মুন্ডারী। তা থেকে আসে ‘জাহের খড’, যা হয়ে দাঁড়ায় ঝাড়খণ্ড। কারণ ‘জাহের খড’ ভারতের সংখ্যাগুরু অনাদিবাসীদের কাছে উচ্চারণের দিক থেকে খটমট লাগে। তাছাড়াও রয়েছে সর্বেসর্বা সংস্কৃত ভাষার চাপ। কুড়মি মাহাতোরা একেই ‘গরাম থান’ বলে থাকেন। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর এইসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার তাগিদায় মূলধারার প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল সিদ্ধহস্ত। তাই সাংবিধানিকভাবেও তাদের সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বরং তাদের চাপ দিয়ে হিন্দুকরণ করবার প্রচেষ্টা সংখ্যাগুরু হিন্দুরা বরাবর সাংগঠনিকভাবে করে আসছে।
বর্তমানে ঝাড়খণ্ডী বলতে যাদের বোঝানো হয় তারা সাঁওতাল, মুন্ডা, খেরিয়া, ভূমিজ খেওয়ার এবং মোহাওলি (অস্ট্রিক) ও ওঁরাও (দ্রাবিড়)। এঁদের ঐতিহাসিকভাবেই ওই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা বলা যেতে পারে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে এঁরাই ঝাড়খণ্ডী। পরবর্তীকালে এই জাতিগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনের আরো জনগোষ্ঠীর আগমন হয়, যেমন বাউরি, মুচি, রাজওয়ার, ধোবি, ভূঁইয়া, সদন, কুড়মি, মণ্ডল প্রভৃতি। এদের মধ্যে চাপে পড়ে বেশিরভাগ অংশই আজ হিন্দু বাঙালি সংস্কৃতিতে মিশে গেছে। যাদের মধ্যে থেকে বেশ কিছু অংশ গোসাঁই আন্দোলন শুরু করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। কিন্ত ততদিনে যা হাওয়ার তা হয়ে গেছে। এরাই পরবর্তীকালে ভারতীয় সংবিধানের ওবিসি তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। তাই এখন পর্যন্ত ১২টি ‘সারনেম’-এর মধ্যে দিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
এই ঝাড়খণ্ডী আন্দোলনকে আরও ভালভাবে বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে আদিবাসী সমাজব্যবস্থা ও অনাদিবাসী সমাজব্যবস্থার তফাতগুলো কী কী। একটা সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা, অন্যটা সাম্যহীন সমাজব্যবস্থা। এই দুটো পরস্পরবিরোধী সমাজব্যবস্থা আজকের ভারতে একইসঙ্গে বর্তমান। ভারতের অনুন্নত অঞ্চল ও সেখানকার মানুষ উন্নত অঞ্চল এবং উন্নত মানুষের দ্বারা শোষিত। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামগুলোকে শোষণ করে শহর এবং সেখানকার মানুষের ফুলে ফেঁপে উঠছে। গ্রামের মানুষের শহরের মানুষের মনোভাব কদর্য। শহরের মানুষ গ্রামের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাকে টিটকিরি দিয়ে দমিয়ে দেয়, যা আদিবাসী সমাজব্যবস্থায় অকল্পনীয় এবং অন্যায় বলে স্বীকৃত।
আদিবাসীদের মধ্যে মূলত সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা চালু থাকায় সংখ্যাগুরু অনাদিবাসী সমাজব্যবস্থার প্রত্যেকটা নির্বাচিত সরকারের সাথেই তাদের শোষক এবং শোষিতের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ভারতের সব থেকে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ অঞ্চল, যার উপর অধিকার আদিবাসীদের। তা কেড়ে নিতে ভারতের প্রত্যেকটা সরকার অস্ত্র তুলে নিয়েছে, আদিবাসীরা প্রতিরোধ করেছে। আসলে ছাপোষা শহুরে উন্নয়নের চেয়ে বরাবরই তারা নিজেদের জাতির ইতিহাস ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
ভারতের ৫০% কয়লা, ১০০% তামা ও ৪০% বক্সাইট আছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পায়ের নীচেই। সেই খনিজের জন্য অতি ধনিক শ্রেণীকে তুষ্ট করতে সরকার আদিবাসীদের বিরুদ্ধে নানা কৌশলে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কেউ এদের উন্নয়নের গোলকধাঁধায় বন্দী করতে চাইছে, আবার কেউ আধাসামারিক বাহিনীর ভয় দেখিয়ে জল-জঙ্গল-জমি থেকে উৎখাত করতে চাইছে। চারবছর ধরে এদের “মূল স্রোতে” আনবার জন্য নেতা, মন্ত্রীরা স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তাদের ভাষা-সাংস্কৃতি নিয়ে মশলাদার গান, সিনেমা বানানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে সরকারের লক্ষ্য পূরণ হতে পারে না। আদিবাসী মানুষ মূর্খ নন?
২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অন্তত ১৭টা রাজ্যের ১০ লক্ষের বেশি আদিবাসী পরিবার তাদের বনভূমির আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদের মুখে পড়ে। ওই রায় দেওয়া হয়েছিল ২০০৬ সালের বনভূমি অধিকার আইনকে অগ্রাহ্য করে। সেই আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে জঙ্গল বা তার ধারেকাছে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে জমির মালিক হিসাবেই গণ্য করতে হবে। ওই রাজ্যগুলো প্রতিদিন সেখানকার সরকারের নেতা-মন্ত্রী, পুলিশ প্রশাসন, আধাসামরিক বাহিনীর হাতে নিরীহ আদিবাসীরা নিয়ম করে অত্যাচারিত-শোষিত হচ্ছে।
ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ প্রায় চার দশকের। সেখানে সরকার নিজের দেশের মানুষের উপরেই ঘন ঘন আকাশ থেকে বোমা নিক্ষেপ করছে। সেখানকার আদিবাসী জনগণ ‘মূলনিবাসী বাঁচাও’ মঞ্চের পক্ষ থেকে বিধানসভা ঘেরাও করার ডাক দিয়েছেন।
ঝাড়খণ্ডে কয়েক হাজার একর বনভূমি দখল করতে নেমে পড়েছে আদানি গোষ্ঠী। সেখানেও সরকার ওই জমি দখল করতে বিদ্রোহী আদিবাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী নামিয়েছে। অসমের চা বাগানেও একই কাহিনী। মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশাতেও জল-জমি-জঙ্গলকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথে আদিবাসীদের দৈনন্দিন লড়াই চলছে। পশ্চিমবঙ্গের “ফ্যাসিবাদবিরোধী সরকার” অতি ধনী আদানি গোষ্ঠীকে তুষ্ট করতে তাদের হাতে রাজ্যের বহু জমি তুলে দিয়েছে, যার মধ্যে আদিবাসী কৃষকদের এলাকা দেউচা পাঁচামি অন্যতম। রাজ্য সরকার হঠাৎ জঙ্গলমহলে ঘন-ঘন মিটিং করছে কিংবা দেউচার আদিবাসীদের উন্নয়নের প্যাকেজ দিয়ে নবান্নয় ডেকে এনে মত বদলানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু আদিবাসীদের সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার কাছে বারবার হার মানতে হচ্ছে।
অনাদিবাসী সাম্যহীন সমাজব্যবস্থার প্রতি সাম্যবাদী আদিবাসীদের আরও ঘৃণার কারণ রাজনৈতিক ফায়দা ছাড়া আদিবাসীদের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর ব্যাপারে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মুখে কুলুপ এঁটে থাকা। আদিবাসীদের বাসভূমিতে প্লেন থেকে বোমা ফেলা হলেও ‘প্রগতিশীল–সাম্যবাদী’ বাম দলগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে একটা বিবৃতি পর্যন্ত দেয় না। ফলে আদিবাসীরা আরও দূরে সরে গেছেন।
আরো পড়ুন মাওবাদী দমনের নামে মধ্য ভারতে ঠিক কী চলছে? অতি সাম্প্রতিক ঘটনার প্রিজমে
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, আদিবাসীরা আছেন এমন সমস্ত রাজ্যে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস সরকার বারবার এ রাজ্যকে আদিবাসীদের জন্য দেশের অন্যতম সেরা বলে দেখানোর চেষ্টা করেছে। পঞ্চাশ লক্ষের বেশি আদিবাসীর বাসস্থান পশ্চিমবঙ্গ ঠিক কী কী কারণে সেরা? দু টাকা কিলো চাল, কিছু আর্থসামাজিক প্রকল্প আর কিছু রাস্তার দুপাশে সাদা আলো। ব্যাস?
অমর্ত্য সেনের প্রতীচি ইনস্টিটিউট ও এশিয়াটিক সোসাইটি পরিচালিত ‘পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী বিশ্ব তদন্ত’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮-২০১৯ সালে। সেই সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীরা দিনে একবার ভারি খাবার খান, প্রোটিন জাতীয় খাবারের অভাবে ভুগছেন। তার আগের সমীক্ষাগুলোতে দেখা গিয়েছিল, আদিবাসীদের গড় আয়ু ৫৮ বছর, যেখানে পুরো পশ্চিমবঙ্গের মানুষের গড় আয়ু ৭০। তবে রাজ্য সরকার এ বিষয়ে কর্ণপাত করতে নারাজ। ২০১৮ সালে অনাহারে সাতজন আদিবাসীর মৃত্যু নিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা তদন্ত করতে গেলে তাঁদের দেশদ্রোহিতাবিরোধী (১২৪এ) আইনে হাজতে ভরে দেওয়া হয়।
গত ১ জুন পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে সাঁওতালরা আসন্ন হুল দিবস উপলক্ষে চাঁদা তুলতে বেরোলে দুজনকে থানায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখে পুলিস। অন্যরা রাস্তা অবরোধ করেন সাথীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভ তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফলে ওই দুজনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কোনোদিন শুনেছেন শহরে দুর্গাপুজোয় কিংবা সংখ্যাগুরুদের কোনো উৎসব পালনের জন্য চাঁদা তুলতে বেরোলে কাউকে আটক করা হয়েছে? এছাড়া কোথাও গোহত্যার অপরাধে খুন, কোথাও উচ্চবর্গীয় মেয়েকে ভালবাসার অপরাধে গাছে বেঁধে পেটানো আদিবাসীদের বিরুদ্ধে এসব অপরাধ হয়েই চলেছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।
সুতরাং ইতিহাস ও বর্তমানের হিসাব কষে স্পষ্ট বলা যায়, আদিবাসীদের নিয়ে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল সমানে ছেলেখেলা করে চলেছে। ধনিক শ্রেণির স্বার্থে আদিবাসীদের পায়ের নীচের মাটির খনিজ সম্পদ উত্তোলনে রাষ্ট্র সবসময় তৎপর। কখনো ঘৃণ্য অপারেশন গ্রিনহান্ট, কখনো অপারেশন সমাধান ও প্রহার (যার চূড়ান্ত পর্যায় এখন চলছে) দিয়ে দেশকে আরও পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মতামত ব্যক্তিগত, তথ্য লেখকের
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।