গত বছর লকডাউনের সময় কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা মজার পরীক্ষা নিরীক্ষা করি। আজ সেই অভিজ্ঞতার গল্পটুকুই শোনাবো।
আমাদের শহরের একপাশে হুগলী নদী আর সেই নদীর তীরে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল। মূলত পাটকল। এর বাইরে ছোট-মাঝারি অন্য কারখানাও রয়েছে।গোন্দলপাড়া জুটমিলের মত বেশ কিছু কারখানা সেই সময় আড়াই বছরের ওপর বন্ধ থাকার ফলে যেন আত্মহত্যার মিছিল লেগেছিল। লকডাউনের পর বন্ধ কারখানাগুলোর শ্রমিকদের মধ্যে খাবার আর রেশন যখন বন্ধুরা মিলে পৌঁছতে যেতাম; প্রতি মুহুর্তে মনের মধ্যে কাঁটার মত বিঁধে থাকতো সেই অমোঘ প্রশ্ন: আর কতদিন?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আর কতদিন এই দয়াধর্মী দান? আর কতদিন দেখতে হবে প্রতিদিন এই মনুষ্যত্বের অবমাননা?লঙ্গরখানার মত হাত পেতে নেওয়া ঐ সামান্য দু সপ্তাহের খাবারটুকু? তারপর কি হবে?
কেউ কেউ অবশ্য দেখেছি এই সকল যুক্তিকে আবার সামনে রেখে নিষ্ক্রিয়তার ওকালতি করেন। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের চরমতম সঙ্কটে পাশে না দাঁড়িয়ে বাক্যবাগীশ হবো এই শিক্ষা পরিবার বা রাজনৈতিক জীবন কোথাও অন্তত পাইনি। কারণ চোখের সামনে দেখেছি বলাগড় থেকে চন্দননগরে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিমি সাইকেল চালিয়ে শ্রমিকরা এসেছেন শুধু ঐ রেশনটুকু পাওয়ার জন্য। লকডাউন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল শহরের গরীবের ন্যূনতম সঞ্চয় বলে কিছু নেই।
বুকের মধ্যে অহরহ বাজতে থাকা সেই যন্ত্রণার উপলব্ধিটুকু থেকে কতকগুলি জায়গায় আমরা একটা অভিনব প্রয়াস নিলাম। শ্রমজীবি পরিবারগুলোকে গিয়ে বললাম, যে রেশন আমরা তোমাদের প্রত্যেক পরিবারকে দুসপ্তাহের মত করে দিচ্ছি (সবটাই চেয়েচিন্তে যোগাড় করে) তার পরিমাণ আমরা বাড়াবো।
কিন্তু দুটো শর্ত থাকবে তার সঙ্গে। তোমরা যারা পাশাপাশি থাকো, কাছাকাছি থাকো, পরস্পরের সুখ-দুঃখে বাঁচো, তাদের পাঁচটি, সাতটি বা এগারোটি পরিবার নিয়ে একটি করে বন্ধু পরিবার তৈরী করতে হবে।
যা রেশন আসবে, ধরে নাও, প্রতি পরিবারে যদি গড়ে পাঁচজন করে থাকো, তবে এগারোটি পরিবার হলে পঞ্চান্নজনের জন্যই আসবে। কিন্তু শর্ত হল, তোমাদের একসঙ্গে রান্না করতে হবে। কেউ আলাদা রান্না করতে পারবে না। এবং খাওয়াদাওয়াও করতে হবে একসঙ্গে। যৌথভাবে। অর্থাৎ রান্নার পর বাড়িতে খাবার নিয়ে গিয়ে খাওয়া চলবে না। যদি রাজি থাকো জানাও।
আমরা বললাম, এই কঠিন সময়ে যৌথ রান্নাঘর আর বন্ধু পরিবার গড়ে রান্না থেকে কাজ সবটাই যদি ভাগ করে নাও, অনেক দিক থেকে সুরাহা হবে তোমাদের। ভেবে দেখো।
সবার সঙ্গে মিটিং করে আমরা দেখিয়ে দিই যে, একটি পাঁচজনের শ্রমজীবি পরিবারে খাওয়ার জন্য যদি মাসিক পাঁচহাজার টাকা আনুমানিক খরচ হয়, তবে সাতটি পরিবারের হবে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা।কিন্তু নুন -তেল- চাল-পাঁচফোড়ন-জ্বালানীর হিসেব কষেও আমরা দেখিয়ে দিই যে, রান্না যদি একসাথে হয়, তবে সেই খরচ নেমে আসে সতেরো হাজার টাকায়। অর্থাৎ পুরো অর্ধেক। এবার এই টাকাটারও যেহেতু পুরো ব্যয় আমরা বহন করবো, ফলত আমরা আশা করতে পারি তোমাদের কিছু কিছু অন্তত সঞ্চয় হবে। আশা করবো, এই দুর্দিনের বাজারে ঐ সঞ্চয়টুকুই হবে তোমাদের প্রাথমিক পুঁজি। যেটুকু থাকলে তোমাদের অন্তত এই মুহুর্তে বন্ধন ব্যাঙ্ক বা ছিপ ফেলে থাকা সুদের কারবারীদের কাছে হাত পাততে হবে না।
বিপুল উৎসাহে কোথাও কোথাও শুরু হয়ে গেল যৌথ রান্নাঘর। কেউ উজ্জ্বলা যোজনার উদ্বৃত্ত গ্যাস দিল, কেউ দিল ওভেন-যেহেতু পুরুষরা সবাই রাজমিস্ত্রীর বা যোগাড়ের কাজ করেন আর তখন কারোরই কাজ নেই তাই সকাল হলেই লেগে পড়তেন তাঁরা। ছেলে-বৌ-শ্বশুর-শ্বাশুড়ী মিলে সে যেন এক উৎসবের মেজাজ। একটা কমন জায়গা দেখে সামিয়ানা খাটানো হল। গল্প-হাসি-রঙ্গ তামাশায় রোজকার একঘেয়ে বিরক্তিকর রান্নাই হয়ে উঠলো আনন্দের আর ভালোবাসার। একটু বড় যারা স্কুলে বা কলেজে পড়ছে, তারা আবার কোনো একটা কমন ঘরে বাচ্চাদের নিয়ে পড়াশোনা করাতে বসতো রোজ।
সবাই মিলে একসাথে রান্না করার এই দৃশ্য আশেপাশের বস্তির লোকও এসে দেখে যেত। কেউ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতো, কেউ বা নিজেই এসে বসে যেত কুটনো কুটতে। মেনু অবশ্য আমরাই ঠিক করেছিলাম প্রতিদিনের। সবার মতামত নিয়েই। সুষম স্বাস্থ্যকর খাবারের যোগান দিয়েই তৈরী হয়েছিল মেনু। মাছ থেকে ডিম-ডাল থেকে সয়াবিন সবই ছিল।পাড়ার এক স্থানীয় ব্যবসায়ী যিনি আবার সত্তর দশকের আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, তিনি সব দেখে উৎসাহিত হয়ে সপ্তাহে একদিন মাছের বাজেটের পুরো দায়িত্বটাই নিয়ে নিলেন। খবরটা পেয়ে যৌথ রান্নাঘরের বাচ্চা-বুড়ো সবার কী আনন্দ!
সবাইকে বলা হয়েছিল একটু একটু করে টাকা জমাতে। যে টাকাটা মাসের শেষে হবে বন্ধু পরিবারের পুঁজি।কারোর ব্যক্তিগত পুঁজি নয় আর।
প্রত্যেক সোমবার করে মিটিং হত। রেশনের হিসাব কে রাখবে, প্রতি সপ্তাহের দায়িত্বে কারা থাকবে, তা নির্বাচন করা হত। এই ব্যাপারটা কিন্তু সপ্তাহে সপ্তাহে বদলে যেত। প্রত্যেকেই পেত দায়িত্বের স্বাদ।।যে শাশুড়ী বউমার প্রতি সদামুখরা, তিনিও বউমার নেতৃত্বে কাজ করতেন। বনিবনা ছিল না যে জায়েদের আর কলোনির বৌদের মধ্যে, একসাথে কুটনো কুটতে কুটতে তারা সুখ-দুঃখের গল্প করতো।
এই সব হতে দেখেছি আমরা। আর তুমুল মজা পেয়েছি। আনন্দ পেয়েছি। আমাদের মনের থেকেও ভার লাঘব হচ্ছিল একটু একটু করে। স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মানুষ যে আমাদের সহযোগিতার আর ভালোবাসার অংশটুকু গ্রহণ করছেন, তা নিজের চোখে দেখে। মনে হচ্ছিলো, যাক, যৌথ খামার না গড়তে পারি, যৌথ রান্নাঘর তো গড়তে পেরেছি।
তিনমাস বাদে প্রথম একটি পরিবার বেরিয়ে গেল।এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যে পরিবারটি বেরিয়ে গেল ঐ এগারোটি পরিবারের মধ্যে তারাই সবচেয়ে দরিদ্রতম। স্বামী-স্ত্রী কারোরই কোনো কাজ ছিল না। তবু তারা বেরিয়ে গেল কেন? জানতে তো হবে।বাকীরা বললো, ওদের নাকি খুব গুমর।
সত্যটা অবশ্য অন্য কিছু ছিল। কেউ বলেনি। কিন্তু সন্ধান করেই তা জানলাম। দরিদ্রতম বলেই বাকিদের থেকে কখনও না কখনও কিছু তির্যক মন্তব্য তারা শুনেছে। রোজকার কাজের যে দায়িত্ব বণ্টন তাতে সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে একটু বেশি কাজের বোঝা তাদের ওপর কেউ কেউ চাপিয়ে দিয়েছে।প্রথম প্রথম তারা সহ্য করেছে। কিন্তু তারপর একসময় মানমর্যাদায় লেগেছে। ফলত যৌথ রান্নাঘরের মাছভাতের থেকে নিজের ঘরে আলুভাতে ভাত খাওয়া বা একবেলা না খেয়ে থাকাও তারা শ্রেয় মনে করেছে। অর্থনৈতিক কারণে আর প্রয়োজনে তারা এক জায়গায় এসেছিল। কিন্তু পরে সংস্কৃতি আর রাজনীতি ছাপিয়ে গেল অর্থনীতিকে।
এরও দুসপ্তাহ বাদে বেরিয়ে গেল আরো দুটি পরিবার। যারা গেল তারা যুক্তি হিসাবে রেখেছিল যে তাদের একসাথে রান্নায় ঝাল মশলা ও তেল খাওয়ার ও পেটের সমস্যা তৈরী করছে। কিন্তু বাস্তব কারণ সেটা ছিল না।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে এবারেও সমাজতত্বের নতুন অভিজ্ঞতা হল। যারা ছেড়ে গেল, তাদের দুই পরিবারেই ছিল ছোট ছোট সন্তান। সন্তানরা তো প্রায়ই কিছু না কিছু আবদার করে অন্য কিছু খাওয়ার। এখন যৌথ পরিবার হওয়ায় এটাই দস্তুর হয়ে গিয়েছিল যে, কিছু কিনলে বা ঘরে আলাদা কিছু রান্না করলে শুধু নিজের সন্তানের জন্য নয়, সকলের জন্যই কেনা বা করা।কেউ বলে নি এটা, চাপিয়েও দেয়নি, কিন্তু এটাই অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। যদিও এই বাড়তি মূল্যের বোঝাটুকু তাদের পক্ষে নিতে না পারা বা বলা বাহুল্য না চাওয়াই তাদের বেরিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে আমরা আবিষ্কার করেছি। আর এই আবিষ্কার গুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের চোখের সামনে মূর্ত্ত হয়ে উঠছিল আশি পরবর্তীকালে আমাদের যৌথ পরিবারগুলি কোন অদৃশ্য কারণে ভেঙে টুকরো হয়ে আজকের পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
শুধু ভাঙন নয় গড়াও ছিল। একাধিক যৌথ রান্নাঘর ও বন্ধু পরিবার এই সময়ে গড়ে ওঠে। আমাদের নীতি ছিল, শর্ত মেনে যতদূর অবধি তাঁরা এই যৌথতাকে ধারণ করতে পারবেন, ততদূর অবধিই এই ধরণের উদ্যোগকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
একসঙ্গে রান্না করার ফলে মহিলাদের প্রচুর সময় উদ্বৃত্ত হত। সেই উদ্বৃত্ত সময়ে তাঁরা আমাদের ব্যবস্থাপনায় হাতের কাজ শিখেছেন। ডিজাইনার কাগজের ব্যাগ তৈরি করেছেন। তা কলকাতায় যোগান দিয়ে অর্থ উপার্জন করেছেন। এখনও ঘরোয়া মার্কেটে ছোট ছোট করে তাঁদের শেখা সেই কারিগরি দক্ষতাকে তারা কাজে লাগিয়ে নিজেরা উপার্জন করছেন। এগুলো সবগুলোই ছিল সদর্থক দিক।
মানুষ গল্পের শেষ শুনতে চায়। আর এ তো গল্প নয় জীবন্ত অভিজ্ঞতা। মানুষকে ভালোবেসে তাঁদের সঙ্গী করে সামান্য পরীক্ষানিরীক্ষা।
যতদিন লকডাউনের চূড়ান্ত সঙ্কটময় দিনগুলি আর তাকে ঘিরে থাকা ভয়ঙ্করতম অনিশ্চয়তার দিনগুলি মাথার উপরে খাঁড়ার মত ছিল, ততদিন যৌথ রান্নাঘরগুলি দাপটের সাথে টিকে থেকেছে। যৌথতার বোধই থেকেছে মুখ্য। বাকি সবকিছু গৌণ। কিন্তু যখন আগের বার ট্রেন চালু হল, একটু একটু করে বাইরে উপার্জনের অন্যান্য রাস্তাগুলি খুলতে লাগলো, ব্যক্তিগত চাহিদা ব্যক্তিগত সুখ আর সম্পত্তিবোধও যেন মাথা তুলতে লাগলো একটু একটু করে। প্রথম পর্যায়ের লকডাউন শেষ হওয়ার প্রাকমুহুর্তেই ভেঙে গেল যৌথ রান্নাঘর ও বন্ধু পরিবার। আমাদেরও নীতি ছিল যতদিন তাঁরা চালাতে চাইবেন, ঠিক ততদিনই এটি চলবে। তার একদিনও বেশী নয়।
এমন অনেককে দেখেছি যারা মনে করেন অর্থনীতি পালটে গেলে সমাজটাও পালটে যাবে এবং অর্থনৈতিক আন্দোলন করলেই তা ধীরে ধীরে রাজনীতির রূপ পেয়ে যাবে। তাই যদি হত তবে যৌথ রান্নাঘর ও তাকে ঘিরে থাকা হাজারো কর্মকাণ্ড কিন্তু একধরণের আর্থিক নিরাপত্তাবোধ তৈরী করেছিল।তার ফলে যৌথতার মূল্যবোধ শক্তিশালী হতে পারতো। প্রাথমিকভাবে হয়েছিলও তাই। কিন্তু প্রতি মুহুর্তে সমাজ জুড়ে তৈরী হওয়া ব্যক্তিগত সম্পত্তির মূল্যবোধের কাছে ঐ যৌথতার ধারণা আর কতটুকু?
আর একইসাথে একথাটুকুও জুড়ে দেওয়া ভালো, এই পরীক্ষা নিরীক্ষায় সচেতন ভাবেই আমরা কেউ ভ্যানগার্ডের ভূমিকা নিইনি। পাশে থেকেছি মাত্র তাঁদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে।
তেভাগার সময়কালে কোন এক গল্পে পড়েছিলাম লেখক লিখছেন আন্দোলনের পীঠস্থান কাকদ্বীপেই এক কৃষক নেতার বাড়ীতে দুপুরে খেতে বসে লেখক লক্ষ্য করেন সারি সারি খেতে বসা মানুষের থেকে অনেকটা দূরে এককোণে নীরবে খেয়ে চলেছেন দুই গ্রামীণ বধূ। জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া যায়, ওঁরা হল বাগদী-বৌ। আরও খোঁজ নিয়ে যা জানা যায়, তা হল, সাম্প্রতিক ধান ঘরে তোলার লড়াইয়ে সামনের সারিতে থেকে যারা মারা গেছেন, তাঁরা ওঁদেরই স্বামী।কিন্তু লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকলেও খাওয়ার পাতে ব্রাত্য শহীদদের পরিবারই।
অপমানে সমান না হয়ে হট্টমেলার এপারে হোক আর ওপারে কোথাওই যৌথতা আর সংঘের নির্মাণ হয় না।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।