তামিলনাড়ু বিধানসভা কক্ষ হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের উপযুক্ত ছিল না বলে এম কে করুণানিধির প্রতিবাদ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মনে রেখেছে কিনা জানা যায় না। আসলে প্রতিবন্ধকতা এমন একটা বিষয় যা নিয়ে আমরা খুব কম চর্চা করি। সংবাদমাধ্যম এই বিষয়টাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে না। শুধুমাত্র কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোনো বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা দেখালে তবেই প্রতিবন্ধীদের নিয়ে খবর হয়। ইংরেজিতে একটা শব্দবন্ধ ব্যবহার করি আমরা প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা — “ইনস্পিরেশন পর্ন”। সমাজ প্রতিবন্ধী মানুষকে ইনস্পিরেশন, অর্থাৎ অনুপ্রেরণা হিসাবে দেখতে ভালবাসে। অথচ তাদের রোজনামচা, সুবিধা-অসুবিধা, সর্বোপরি রাজনৈতিক অধিকার সাধারণত আলোচনায় আসে না। প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা বা চাকরির/ কাজের সুযোগ নিয়ে তবু সমাজসেবামূলক সংস্থাগুলো কাজ করে, কিন্তু এদের রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বিষয়ক আলোচনা একেবারেই চোখে পড়ে না। হয়ত এইজন্যই রাজনৈতিক দলগুলোও প্রতিবন্ধীদের সমস্যাগুলো যে তাদের কাজের বিষয় হওয়া উচিত সেটাই ভুলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিসরে একমাত্র ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে সিপিএম দলটাকে।

কেরালার কান্নুরে এখন সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস চলছে। তার রাজনৈতিক সংকল্পপত্রের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে এই দলের কাছে কিন্তু বিষয়টা নতুন নয়। ২০০৯-১০ সাল থেকেই সিপিএম আলাদা করে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজকর্ম শুরু করেছে। এই কাজের জন্য তাদের আলাদা ফ্রন্টও আছে। কান্নুর কংগ্রেসে সেই ফ্রন্টের সদস্যরাও যোগ দিয়েছেন। কান্নুরে সভাস্থল প্রতিবন্ধী-বান্ধব করার জন্য সিঁড়ি কমিয়ে র‍্যাম্পের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এছাড়াও সিপিএমের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর রাইটস অফ ডিসএবেল্ড (এনপিআরডি) নামে এক সর্বভারতীয় মঞ্চ। এই মঞ্চের বেশিরভাগ সদস্যই পার্টি সদস্য, তবে এই মঞ্চের বিশেষত্ব হল এখানে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের সব মানুষকে এক জায়গায় আনার চেষ্টা হয়েছে। পার্টির বাইরের অনেক প্রতিবন্ধী আন্দোলনকর্মীও এই মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

এই মঞ্চ তৈরি হওয়ার অনেক বছর আগেই অবশ্য এই সংগঠনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট কান্তি গাঙ্গুলি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী তৈরি করেছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কান্তিবাবু ছাড়া আর কোনও মন্ত্রী প্রতিবন্ধকতার মত প্রান্তিক বিষয়ে এত সময় দিয়েছেন বা কাজ করেছেন বলে জানি না। এনপিআরডির এক সভায় তিনি বলেছিলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা মানে আমাদের দেশে এখন যে বিভেদমূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার বিরুদ্ধেই কাজ করা। এ কথা আমরা জানি যে প্রতিবন্ধী মানুষ ছাত্র হতে পারে, নারী হতে পারে, চাকুরিজীবী বা বেকার হতে পারে। প্রতিবন্ধী মানুষ যে কোন ধর্মের হতে পারেন, যে কোন বর্ণের হতে পারেন এবং যে কোনো লিঙ্গের হতে পারেন। এইসব বিভিন্নতাকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে পারে প্রতিবন্ধী আন্দোলন । আমাদের আমাদের দেশের রাজনৈতিক চর্চায় এখন সবরকম বৈচিত্র্য নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কাজেই এনপিআরডি-র কাজে নানা বাধা এসেছে। প্রতিবন্ধকতা নিয়ে চর্চা কেবল এনজিওগুলো করবে, এমনটাই এ দেশে দস্তুর। এনপিআরডির কাজকে কেউ কেউ ভয় পেতে শুরু করেছেন। এই মঞ্চের জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দকে তাই কোনো বড় ক্যাম্পেন শুরু হলেই হুমকি ফোন বা ইমেল করা হয়ে থাকে। যদিও মোটের উপর প্রতিবন্ধী আন্দোলনের মানুষ এই মঞ্চের কাজকে স্বাগত জানিয়েছেন।

এখানে বলে রাখা ভাল, ১৯৯৫ সালের আগে আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা করে কোনো আইন ছিল না। সে বছর যে আইন পাস হয় তা রদ হয়ে এখন এক নতুন আইন এসেছে। আমরা প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা অবশ্য ১৯৯৫ সালে আনন্দিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে এতদিনে অন্তত আমাদের দেশের আইনসভা আমাদের কথা ভেবেছে। কিন্তু একটা ক্ষোভ ছিল, কারণ আইন পাশ হয় সংসদের দুই কক্ষে কোনোরকম আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই। মনে হয়েছিল, কোনো রাজনৈতিক দলই প্রতিবন্ধী আইন নিয়ে কথা বলতে রাজি নয়। এই আইন রদ হয়ে যখন নতুন আইন ২০১৬ সালে পাশ হয়, তখন কিন্তু দেখা গেল সংসদে কিছুটা আলোচনা হয়েছে। প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা লক্ষ্য করেন, সিপিএম দলই সবথেকে রাজ্যসভা ও লোকসভায় এই নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলেছিল। বিশেষ করে রাজ্যসভায় সীতারাম ইয়েচুরি যে কথাগুলো বলেন, তা এই আইনকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে বলে আমাদের মনে হয়েছিল।

২০২২ সালেও রাজ্যসভায় প্রাইভেট মেম্বার বিল এনে প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্য দূর করার চেষ্টা চালাচ্ছেন এক সিপিএম সাংসদ। সমস্যা হল, প্রতিবন্ধকতা বিষয়টাকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগু এখনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে চিহ্নিত করেনি। প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে আমাদের আশা, দেশের সব রাজনৈতিক দলই আলাদা করে ডিসএবিলিটি ফ্রন্ট তৈরি করবে। প্রতিবন্ধকতা ‘চ্যারিটি’ হিসাবে নয়, রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের সামনে উদাহরণ হিসাবে সিপিএম ছাড়া অন্য কোনো দল নেই।

মতামত ব্যক্তিগত

আরো পড়ুন

স্কুল খুলছে, কিন্তু প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের কী হবে?

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.