বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ফিরোজ শাহ কোটলা বা অধুনা অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে সেদিন সদ্য একটি একদিনের ম্যাচ জিতেছে ভারত। হইহই ব্যাপার, রইরই কান্ড। মাঠ ভর্তি দর্শক ক্ষণে ক্ষণে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, ভারতীয় ক্রিকেটাররা বীরদর্পে ঘুরছেন। যথারীতি মাঠ পরিক্রমা শুরু করলেন ভারতীয় দলের সদস্যরা। হঠাৎ দেখা গেল দৌড় থামিয়ে এক লাফে লোহার রেলিং পেরিয়ে ভিআইপি গ্যালারিতে ঢুকে গেলেন বিরাট কোহলি ও শিখর ধাওয়ান। দুজনেই দিল্লির স্থানীয় ক্রিকেটার। কী ব্যাপার? না, দুজনের চোখে পড়েছে কোণের দিকে চেয়ারে বসে আছেন বিষাণ সিং বেদি। দুজনেই তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। তাঁকে দেখেও অগ্রাহ্য করে চলে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো দিল্লি ক্রিকেটারের কোনোদিন ছিল না। এই ব্যাপারে ব্যতিক্রমী হওয়ার দুঃসাহস কোহলি, ধাওয়ানদের মত তাবড় তারকাদেরও ছিল না।

না, তা বলে কেউ যদি ভেবে বসেন, কোহলিরা যা করতে সাহস পাননি, তা করবার সাহস অন্য কারোর ছিল না, তবে সে গুড়ে বালি। কোটলা মাঠে এমন অনেক লোক ছিলেন এবং আজও আছেন, যাঁদের সাহসের, যাকে বলে অন্ত নাই রে নাই। বিশেষ করে যাঁরা কোনোদিন ক্রিকেট না খেলেও দিল্লি ক্রিকেটের হর্তাকর্তা হয়ে বসেছেন, তাঁদের মধ্যে একদল লোক। তাই শেষ জীবনে নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিলেন বেদি। যে মাঠের নিয়মিত দর্শকরা আজও বেদির কথা উঠলে মাথায় হাত ঠেকান, সেই মাঠেই ব্রাত্য হয়ে গেলেন তিনি। শেষ কয়েক বছর কোটলায় পা রাখতেন না। দুষ্কর্মের প্রতিবাদ করবার প্রতিফল হিসাবে তাঁকে চরম দণ্ড দিল দিল্লি ক্রিকেট।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

দিল্লির সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার কে, এই হিসাব করতে বসলে প্রথমেই কি উঠে আসবে বেদির নাম? না, এক্ষেত্রে বেশ কিছুটা অসুবিধায় পড়বেন দেশের চিরশ্রেষ্ঠ বাঁ হাতি স্পিনার। মহিন্দর অমরনাথ, বীরেন্দর সেওয়াগ এবং সর্বোপরি বিরাট কোহলি – এঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে বেদিকে। কিন্তু যদি বলা যায় আধুনিক দিল্লি ক্রিকেটের জনক কে? তাহলে বেদি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নাম উঠে আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই বললে মোটেই অত্যুক্তি করা হবে না।

অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস! সেই বেদিকে কার্যত নির্বাসন দিল দিল্লি ক্রিকেট। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে যেদিন সিদ্ধান্ত হল আজ থেকে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহাসিক কোটলার নাম হয়ে গেল অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম, সেদিনই বেদি দিল্লি ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (ডিডিসিএ) সদস্যপদ ছেড়ে দিতে চিঠি দিলেন সংস্থার সভাপতি রোহন জেটলিকে। সরাসরি জানালেন, এই সিদ্ধান্ত ন্যক্কারজনক এবং ক্রিকেটবিরোধী। অরুণ জেটলি অসাধারণ রাজনীতিবিদ, তাঁর নামে সংসদ ভবনের নামকরণ হোক, কিন্তু ক্রিকেট মাঠের নয়। বেদি লিখলেন, কোটলায় যে স্ট্যান্ডটি তাঁর নামে আছে, সেটির নামও যেন বদলে দেওয়া হয়। অক্রিকেটিয় লোকজনের সঙ্গে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

বেদির দুর্ভাগ্য, পাশে কাউকে পেলেন না। একজন কেউ এগিয়ে এসে বললেন না, ২৬৬ টেস্ট উইকেটের মালিক এই চলমান কিংবদন্তি অন্তত ক্রিকেটের ব্যাপারে কিছু কিছু ঠিক কথা বলেন, ওঁর কথাগুলো আমরা একটু শুনে নিই না হয়। সঙ্গীহীন বেদি অসহায় দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর শুষ্ক, অবনত মুখে নিঃশব্দে চিরবিদায় নিলেন তাঁর প্রিয়তম মাঠ থেকে।

বেদি আশা করেছিলেন, কেউ একজন বলবেন, বহুবছর আগে যখন লাহোরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মূর্তি বসাবার কথা উঠেছিল, তখন প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন ফজল মহমুদ, নাসিম উল গনির মত প্রাক্তন ক্রিকেটাররা। আজ ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক আব্দুল হাফিজ কারদারের মূর্তি। বেদি সম্ভবত আশা করেছিলেন কেউ একজন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন যে এই একই কাজ করতে গিয়ে পিছিয়ে যেতে হয়েছিল শ্রীলঙ্কা সরকারকে, কারণ সেবার গর্জে উঠেছিলেন দিলীপ মেন্ডিসসহ অনেকেই। বেদি দেখলেন এখানে তিনি একা।

যখনই প্রতিবাদ করেছেন, তখনই একঘরে হয়েছেন বেদি। যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিবে যায় বারে বারে… আমার জীবনে তব সেবা তাই বেদনার উপহারে। ক্রিকেট দেবতাকে বুঝি এমন কথাই বারংবার বলেছেন বেদি। সেবার শ্রীলঙ্কার স্পিনার মুথাইয়া মুরলিধরনকে নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি। মুড়ি মুড়কির মত উইকেট নিচ্ছেন, কাটা সৈনিকের মত ধরাশায়ী হচ্ছেন বিপক্ষ ব্যাটাররা। ছন্দপতন ঘটালেন বেদি। পরিষ্কার বলে দিলেন, মুরলিধরন বল ছোঁড়েন। ও আবার বোলার নাকি? ও তো জ্যাভেলিন থ্রোয়ার। বেদির এহেন উক্তিতে চটে লাল উপমহাদেশের ক্রিকেটভক্তরা। হিংসুটে বৃদ্ধ – এই তকমা লাগিয়ে দেওয়া হল বেদির গায়ে। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নিজ বক্তব্যে শেষদিন অবধি অনড় থেকেছেন তিনি।

সামনে থেকে যাঁরা বেদিকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, এই প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক আদতে একজন চমৎকার মানুষ। ভালরকম পড়াশোনা করেছিলেন চিরকাল, ক্রিকেটের উপর শ্রেষ্ঠ বইগুলির প্রায় প্রতিটি তাঁর আলমারিতে স্থান পেয়েছিল। অসম্ভব মজলিশি মানুষ ছিলেন, অসাধারণ গল্প বলতে পারতেন, ছিল প্রবল রসবোধ।

কিন্তু তারা উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর। ভারতীয় ক্রিকেট যাঁরা চালান, তাঁদের কাছে বেদি ছিলেন তাই। অন্যায় দেখলে বেদি প্রতিবাদ করবেনই এবং সেখানেই যাবতীয় গন্ডগোল। তখন দিল্লি ক্রিকেট চালান দোর্দণ্ডপ্রতাপ অরুণ জেটলি এবং তাঁর পার্শ্বচররা। ডিডিসিএ-তে প্রতিটি নির্বাচন তিনি হাসতে হাসতে জেতেন, বিরোধী পক্ষ নামক কোনো বস্তু তখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সেবারও বোমা ফাটালেন বেদি। বললেন, দিল্লি ক্রিকেট এখন স্রেফ দুষ্কৃতকারীদের আড্ডা। বলেই ক্ষান্ত হলেন না, নিজেই দাঁড়িয়ে পড়লেন নির্বাচনে। যথারীতি হেরে ভূত হল তাঁর দলবল, কিন্তু চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়ে গেল জেটলি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের। প্রচুর ক্রিকেটপ্রেমী প্রকাশ্যে আক্ষেপ করলেন দিল্লির প্রথম রঞ্জি ট্রফি জয়ী অধিনায়ককে এইভাবে রাজনীতির বলি করা হল বলে।

আরো পড়ুন তুলসীদাস বলরাম: নিভৃত প্রাণের দেবতা

স্যার গ্যারি সোবার্স একবার বলেছিলেন, তাঁর দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনে তিনি যত ক্রিকেটার দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত একটা দিক দিয়ে তিনি বেদিকে সবচেয়ে এগিয়ে রাখবেন – ওঁর মত সপাটে সোজা কথা বলা এবং মেরুদণ্ড সোজা করে চলা মানুষ আর দেখেননি। কিন্তু সেটাই বুঝি বেদির কাল হয়ে দাঁড়াল। যত্রতত্র অপ্রিয় কথা বলার অভ্যাস তাঁর শেষ বয়স অবধি গেল না। ফলত শেষ কয়েক বছর প্রায় কোনো অনুষ্ঠানে তিনি ডাক পেতেন না, কোনো চ্যানেল তাঁকে ধারাবিবরণী দিতে নিমন্ত্রণ জানায়নি। বেশ কয়েক বছর তিনি দেশের অধিনায়কত্ব করেছেন, কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তাঁর সম্বন্ধে থেকে গেছে নেহাত নির্লিপ্ত।

ব্যক্তিগত আলাপে অনেকেই তাঁকে বলেছেন, বেদি সাব, এবার একটু মুখটা বন্ধ রাখলে হয় না? বেদি হয় তাঁর ট্রেডমার্ক প্রাণখোলা হাসি হেসেছেন, অথবা নেভিল কার্ডাস কিংবা জ্যাক ফিঙ্গলটনের কোনো বই থেকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন আদর্শ ক্রিকেটারের এমন করেই বাঁচা উচিত। সন্দেহ নেই নিজের মত করেই শেষ দিন অবধি বাঁচলেন বেদি। তাঁর ঘুরন্ত বলে স্টেপ আউট করে খেলাই বেদিকে শেষ করে দেবার সহজতম উপায়, এমন মন্তব্য করে পরের কাউন্টি ম্যাচেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্টাম্প আউট হয়ে কাঁচুমাচু মুখে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন মাইক ব্রেয়ারলি। সেই ভুল করবার সাহস দেখাননি ভারতীয় ক্রিকেটের কর্মকর্তারা। তাঁরা বেদিকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছেন; যদিও বেদির তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ তাঁদের ক্রমাগত বিদ্ধ করেছে। শেষ কয়েক বছর বেদি নিজেও সম্ভবত কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর মেহরলি ফার্ম হাউজের সীমার মধ্যেই। আমায় থাকতে দে-না আপন-মনে মনোভাব বুঝি শেষদিকে তাঁকে গ্রাস করেছিল।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.