একুশ শতককে পরিবেশ ভাবনার শতক হিসাবে চিহ্নিত করার কথা অনেক বিশিষ্ট মানুষই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বারংবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন । অনেকের ধারণা একুশ শতকে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি জলের অধিকার নিয়ে যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল। একদিকে উপকূল এলাকা লোনা জলে ভরে যাওয়ার আশঙ্কায় পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষ দিন গুনছেন, অন্যদিকে মিষ্টি জলের চাহিদা মেটাতে সৃষ্টি হচ্ছে যুদ্ধের বাতাবরণ। বড় কঠিন এ সময়। এরকম একটা কঠিন সময়ে ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বছর তিনেক আগে। ভারতে পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন আইন থাকলেও সেগুলো প্রধানত নিয়ন্ত্রণমূলক আইন। কখনোই সামগ্রিক পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সুসংহত পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত শুক্রবার ছিল বসুন্ধরা দিবস। সেই অছিলায় বর্তমান ভারতের কয়েকটি পরিবেশ সমস্যার দিকে নজর দিলে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা অনেক সহজ হবে।

*১৯৮৬ সালে ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ নদী গঙ্গার শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই পরিকল্পনার ব্যর্থতা উপলব্ধি করে গঙ্গা উপত্যকা কর্তৃপক্ষ নামে একটি নতুন সংস্থার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার সভাপতি এবং রাজ্য স্তরে মুখ্যমন্ত্রীদের নেতৃত্বে প্রত্যেক রাজ্যে গঙ্গা উপত্যকা কর্তৃপক্ষ তৈরি করা হয়েছে। গঙ্গার গঙ্গাপ্রাপ্তি রোধ করার জন্য আবার একটি সরকারি প্রচেষ্টা! দুঃখের বিষয় এই প্রচেষ্টাও সাফল্যের মুখ দেখেনি। গঙ্গার দূষণমুক্তি বা ভাঙন রোধ — কোনোটাই করা যায়নি। এদিকে দেশের অন্যান্য নদীগুলোও ভয়ংকরভাবে দূষিত হয়ে গেছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

*ভারতবর্ষের বিস্তৃত সমুদ্র উপকূলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৯১ সালে একটি আইন তৈরি করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও পূর্ব মেদিনীপুরের মন্দারমণিতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে হোটেল নির্মাণের কাজ অব্যাহত আছে। এ ঘটনা যে কেবলমাত্র মন্দারমণিতেই ঘটেছে এমন নয়, দেশের বিভিন্ন সমুদ্র উপকূলে কৃত্রিম উপায়ে চিংড়ি মাছের চাষ বা নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করে হোটেল গড়ে তোলার আয়োজন সর্বজনবিদিত।

*ভারতবর্ষের বিভিন্ন বড় বড় শহরে যানবাহনের কারণে দূষণের অবস্থা উদ্বেগজনক। শুধুমাত্র বিচারবিভাগের আনুকূল্যে কিছু কিছু শহরে এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিক সমস্যার নিরীখে তা অকিঞ্চিৎকর।

*গত কালীপুজোর রাতে সমস্ত বড় বড় শহরে শব্দদানবের তাণ্ডবে মানুষ অতিষ্ঠ হয়েছে। হাসপাতালের শয্যাশায়ী রোগীরাও পরিত্রাণ পাননি। হাসপাতালের নার্সিং দিদিমণিরা কানে তুলো দিয়ে তাঁদের সেবায় ব্যস্ত থেকেছেন।

*স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য অতিষ্ঠ। মাঠের ফসল কালো হয়ে যাচ্ছে, কারখানা সংলগ্ন গ্রামগুলোকে গ্রাস করছে সর্বগ্রাসী দূষণ।

*পাথর খাদান বা ইটখোলার শ্রমিকদের পেশাগত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে এবং অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত সেই শ্রমিকদের বেশিরভাগই আদিবাসী।

*রেলগাড়ির ধাক্কায় কিংবা খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে প্রবেশ করা হাতি এবং অন্যান্য বন্য জন্তুর মৃত্যু আজ আর কোনো নতুন ঘটনা নয়।

ভারতবর্ষে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সামগ্রিক সমস্যায় উপরোক্ত ঘটনাগুলো একটা ভগ্নাংশ মাত্র । ১৯৭২ সালে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথম আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তাঁর মত অনুযায়ী, দারিদ্র্য পরিবেশের অন্যতম শত্রু। প্রয়াত নেত্রীর এই উক্তি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পরিবেশ বিষয়ক ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়ন। আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুযায়ী, পানীয় জলের অভাবে পৃথিবীর অন্তত দুশো কোটি মানুষ আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই দুশো কোটি মানুষই এশিয়া বা আফ্রিকায় বসবাসকারী মানুষ । ভারতবর্ষের জনসংখ্যার একটি বড় অংশও জল না পাওয়া এই দুশো কোটির অংশ।

১৯৭২ সালের পর পঞ্চাশটা বছর পার হয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা ভারতবর্ষের অর্থনীতির উন্নতিতে শ্লাঘা অনুভব করছেন। এমনকি আজকের পৃথিবীর প্রথম একশো জন ধনী ব্যক্তির নামের তালিকায় ভারতের বেশ কয়েকজন শিল্পপতির নাম লেখা হয়ে গেছে। এতে অনেকেই উৎফুল্ল। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষুধা সূচকের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ভারতের নাম অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে একেবারে উপরের সারিতে জ্বলজ্বল করছে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের কয়েক কোটি মানুষ ক্ষুধার জগতে বাস করেন, দিনান্তে দুমুঠো খেতে পান না। ক্ষুধার সাম্রাজ্য এদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ক্ষুধার সাম্রাজ্য চলছে।

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৬১ কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন জায়গায় লাইনে দাঁড়িয়ে দেশের শাসক নির্বাচিত করেছেন। ভারতের মসনদে বসার জন্য যে কয়েক হাজার প্রার্থী ভোটযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, তাঁদের ঝুলিতে অসংখ্য প্রতিশ্রুতি। একটি কথাই তাঁরা সকলে চিরকাল বলে এসেছেন বা ভবিষ্যতেও বলবেন “আমরা জনগণের সঙ্গে ছিলাম, জনগণের সঙ্গে আছি এবং থাকব”। অতীতে যাঁরা মসনদে বসেছেন, তাঁরাও এই একই কথা বলেছেন। কিন্তু ভারতের প্রান্তিক মানুষের দুঃখ লাঘব হয়নি। প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে ক্রমাগত পুঁজি তৈরি হয়েছে আর তার সুফল পেয়েছে মুষ্টিমেয় মানুষ। অন্যদিকে অগণিত জনগণ বাধ্যতামূলকভাবে লাঞ্ছিত, দূষিত জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। ভারতবর্ষের উন্নয়নের সোপানে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পরিবেশরক্ষা প্রকৃতপক্ষে ব্রাত্যই থেকে গেছে।

একবিংশ শতাব্দী পরিবেশগত সংকটের শতাব্দী হিসাবে চিহ্নিত। কিন্তু ভারতবর্ষ এই সংকটের মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত বা সতর্ক সেই প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা হলেও তা কখনোই এমন মাত্রায় পৌঁছয়নি যা রাজনীতিবিদদের দেশ চালানোর পরিকল্পনায় উপযুক্ত স্থান পায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবীর দশটি নদী শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যে দশটি নদীকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে দুটি নদী (গঙ্গা ও সিন্ধু) ভারতবর্ষে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ভারতের নদীগুলোকে সজীব রাখার জন্য কোনো বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা নেই। দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য যে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হচ্ছে তারও বৈজ্ঞানিকভাবে পুনর্ব্যবহারের জন্য বিশেষ কোনো সর্বভারতীয় নীতি নির্ধারিত হয়নি। দ্রুত ফুরিয়ে আসা কয়লা ও তেলের ভান্ডার আগামীদিনে যে বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করবে তার মোকাবিলার জন্যও আমাদের কোনোরকম প্রস্তুতি নেই।

গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলোই দেশের উৎপাদনের নীতি নির্ধারণ করে থাকে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষাকর্তা হিসাবে কাজ করে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলো দেশ শাসনের কর্মসূচিতে পরিবেশবান্ধব নীতি অনুসরণ না করলে পরিবেশ বিষয়ক কোনো আইনই কখনো কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না। কিছু কিছু পরিবেশ বিষয়ক আইন কার্যকর করতে গেলেও রাজনীতিবিদরা অস্থিরতা প্রকাশ করে ফেলেন। ফলে আইনগুলো ব্যর্থ হয়ে যায়।

সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে পরিবেশরক্ষার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছে। এমনকি কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারা এই উদ্দেশ্যে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান করেছে, যা আশাব্যঞ্জক। পরিবেশ সংরক্ষণ অনিবার্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “নতুন কাল মানুষের কাছে নতুন অর্ঘ্য দাবী করে, যারা যোগান বন্ধ করে দেয় তারা বরখাস্ত হয়”।

মতামত ব্যক্তিগত

আরো পড়ুন

পরিবেশবান্ধব নগরায়নের সন্ধানে

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.