অনভিপ্রেত কিছু ঘটনাকে সাক্ষী রেখে ২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গের পৌর নির্বাচন শেষ হয়েছে। তার পরেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে অব্যাহত আছে বেশ কিছু ঘটনা; যা সুস্থ বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। ভাবতে অবাক লাগে, গত দু বছর অতিমারীর সময়ে আমরা শহরতলিতে এমন অনেক সমস্যা দেখেছি, যা আমাদের অজানা ছিল। অতিমারীর মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের বুকে বিধ্বংসী ঝড় বুঝিয়ে দিয়ে গেল প্রকৃতির রোষ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। বিশ্ব উষ্ণায়ন, অতিমারির প্রকোপ — সবকিছুই আমাদের ভাবাচ্ছে আগামী দিনে নগরায়ন কী চেহারা নেবে।

অতিমারী মূলত শহর ও শহরতলিকে আক্রমণ করেছিল, গ্রামবাংলায় প্রভাব ছিল সীমিত। নগর পরিকল্পনার বিশেষজ্ঞরা সুনির্দিষ্টভাবে বলছেন, আগামী দিনে, বিশেষ করে ২০৩০ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শহরতলিতে আশ্রয় নেবে। গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে শহরে চলে আসার স্রোত দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত আছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগের ফলে প্রায় দু কোটি ছিন্নমূল মানুষ কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের শহরতলিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলত কল্যাণী বা সল্টলেকের মতো পরিকল্পিত নগরায়ন গড়ে তোলার অবকাশ পশ্চিমবঙ্গের কাছে ছিল না। তবুও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে এবং আজকের দিনে দুটো বিষয় নগরায়নের ক্ষেত্রে মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক সমস্যা এবং অতিমারীর প্রকোপ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

ভারতীয় সংবিধানে তিন ধরনের সরকারের কার্যক্রম সুপ্রতিষ্ঠিত — কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকার দুটো ভাগে বিভক্ত। শহর এলাকায় পৌর প্রশাসন আর গ্রামাঞ্চলে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। নগরায়ন সুষ্ঠুভাবে বর্ধিত না হলে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তার পরিণাম যে কী হতে পারে সে কথা কারোর অজানা নয়। খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে সিন্ধু নদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর বৃহত্তম নগর সভ্যতা যা সিন্ধু সভ্যতা হিসাবে ইতিহাসের পাতায় চিত্রিত। এই সিন্ধু সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তবুও মানুষ শিক্ষা নেয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বুকে নগরায়নের কথা আলোচনা করতে গেলে তাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যেতে পারে — (১) সমতল ভূমিতে নদীকেন্দ্রিক নগরায়ন, (২) সমুদ্র উপকূলভিত্তিক নগরায়ন এবং (৩) পার্বত্য এলাকার নগরায়ন।

পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভাগুলোর ৯০ ভাগ গঙ্গা এবং দামোদর উপত্যকায় অবস্থিত। এমনকি শিল্পকেন্দ্রিক নগরায়ন হয়েছে দামোদর ও গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে। এই বিস্তৃত নগরায়নের ফলে নদী হয়েছে বিষাক্ত, বায়ুমণ্ডল হয়েছে দূষণে ভারাক্রান্ত, শব্দ যন্ত্রণায় শহরের মানুষ আতঙ্কিত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্জ্যের অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার ফলে সৃষ্ট দুর্গন্ধ ও দূষণ। শহরগুলো মুড়ে ফেলা হয়েছে ফ্লেক্স আর বিজ্ঞাপনে। সবুজের চিহ্ন নেই, যেটুকু ছিল তাকে ধ্বংস করতে গাছ মাফিয়া সদা ব্যস্ত। শহর জুড়ে জলাশয় বুজিয়ে ফেলার জন্য সদা সক্রিয় জল মাফিয়া। এমনকি নদী, প্রাকৃতিক জলাভূমি বুজিয়ে ফেলতে কিছু মানুষ অত্যন্ত সক্রিয়।

এতকিছুর মধ্যে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি বিশ্ব উষ্ণায়নকে রোধ করতে পরিবেশবান্ধব নগরায়নের কোনো আইন রচিত হয়নি? পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বুকে পরিবেশবান্ধব নগরায়নের ব্যাপারে কিছুই কি প্রাজ্ঞজন বলেননি? পশ্চিমবঙ্গের নগরায়নে প্রাজ্ঞজনের ভাবনার প্রতিফলন প্রায় শূন্য। রবীন্দ্রনাথ মুক্তকণ্ঠে বলেছিলেন “অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু।” কতদিন আগে কবি বলে গেছেন প্রকৃতির অধিকার বজায় রেখেই সভ্যতার অগ্রগতি ঘটাতে হবে। আধুনিক পৃথিবীর নগরায়ন ও বাসভূমি নির্মাণ সংস্কৃতির অন্যতম স্থপতি স্কটিশ জীববিদ ও অধ্যাপক প্যাট্রিক গেডেস ও তাঁর ছেলে আর্থার গেডেস রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে এসেই আধুনিক নগরায়নের জীবনের ছন্দ অধ্যয়ন করেছিলেন।

ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পরে দেরিতে হলেও পরিবেশবান্ধব নগরায়ন গড়ে তোলার জন্য বেশ কিছু আইন প্রণীত হয়েছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য সর্বতোভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। বিশ্ব পরিবেশ আন্তর্জাতিক বার্তাতেও সবুজ নগরায়নের কথা বারবার ঘোষিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বার্তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ দেশে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তৈরি হয়েছে, প্রণীত হয়েছে নানাবিধ আইন। সেগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার দায়দায়িত্ব নগরায়নের কর্ণধার পৌর প্রশাসন এবং রাজ্য ও কেন্দ্রের পৌর বিষয়ক দপ্তরের। পরিকল্পিত নগরায়ন করতে গেলে কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী পরিবেশ সমীক্ষা করতে হয়। সেখানেই আলোচিত ভূগর্ভস্থ জলের অবস্থান তথা সবুজায়ন এবং আগামী দিনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা আলোচিত হওয়ার কথা। তাছাড়াও বেশ কয়েকটা আইন অনুযায়ী পৌর প্রশাসন দায়বদ্ধ। যেমন জলাশয় সংরক্ষণ, সবুজায়ন, বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা, প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ, হেরিটেজ সংরক্ষণ, প্রবীণ নাগরিক ও বিশেষভাবে ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের দেখাশোনা। এমনকি ভবঘুরে, আশ্রয়হীন মানুষের দেখাশোনার দায়িত্বও আইন অনুযায়ী পৌর প্রশাসনের উপর ন্যস্ত হয়েছে।

অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষাসহ নাগরিকদের খাদ্য সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের দায়িত্বও আজ পৌর প্রশাসনের। আজকের পৌর প্রশাসন সাংবিধানিকভাবে এবং বিভিন্ন আইনের দৌলতে বহু ক্ষমতার অধিকারী। এগুলোর সাহায্যে শহরের বাসিন্দাদের স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার কথা। বর্তমান পরিস্থিতিতে অতিমারীর সময়ে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে, সেগুলো মোকাবিলা করার দায়িত্বও অনেকটাই পৌর প্রশাসনের।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও পৌর প্রশাসনগুলো যথেষ্ট সচেতন কিনা। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বিভিন্ন শহরে কোনোরকম বাধা ছাড়াই জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে বা উন্নয়নের নামে গাছ কাটা চলছে। পৌর প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে অথবা তাদের নীরব সম্মতিতে দুর্বৃত্তরা তাদের অপকর্ম করে চলেছে। এমনকি বিচার বিভাগ বুজে যাওয়া জলাভূমিকে পুনরায় জলাভূমিতে রূপান্তরিত করার নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। নদী, খাল, বিল পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে। জলাভূমি বা গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া মানেই জীববৈচিত্র্যের অবসান। পৌর প্রশাসন জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে দায়বদ্ধ। কিন্তু এই দায়বদ্ধতা আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। আইন আছে, কার্যকারিতা নেই। দায়িত্ব আছে, উদ্যোগ নেই। এই উদ্যোগহীনতার কার্যকারণ খোঁজা প্রয়োজন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আইন কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যবস্থার দিকে তাকালেই দেখা যায় দুর্নীতি আর অস্বচ্ছতার অসংখ্য উদাহরণ। গৃহহীনদের গৃহ দেবার প্রকল্পেও উঠছে নানা অভিযোগ। প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত বলেই সমস্ত আইন লঙ্ঘন করে বহুতল গড়ে ওঠে, কলকাতার পূর্ব দিকে অবস্থিত জলাভূমি সংকুচিত হয়, সমুদ্রোপকূলের জীববৈচিত্র্য নির্মমভাবে ধ্বংস করে গড়ে ওঠে কংক্রিটের জঙ্গল। বেঁচে থাকার স্বার্থে, আগামী প্রজন্মের স্বার্থে, পরিবেশ আইন কার্যকরী করে সবুজ নগরায়ন করতে নাগরিকদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।

মতামত ব্যক্তিগত

আরো পড়ুন

ডুমুরজলায় খেল নগরী: উন্নয়নের স্টিমরোলারে বিপন্ন পরিবেশ, বিপন্ন স্থানীয় জনগোষ্ঠী

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.