প্রতীপ নাগ

মে দিবস উদযাপন আজ আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। কারখানার গেটে গেটে নিয়মরক্ষার পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদিতে মাল্যদান আর বিকেলে ময়দানে সভা। আট ঘন্টা কাজ, আট ঘন্টা বিশ্রাম আর আট ঘন্টা বিনোদন এখন সুদূর অতীত। পিছু হঠতে হঠতে এই দেশের শ্রমিক আন্দোলন এখন রক্ষণাত্মক। ধারাবাহিক সংগ্রামের বদলে বছরকার উৎসবের মত একদিন বা দুদিন সর্বভারতীয় ধর্মঘট। যদিও এই ধর্মঘটে কিছুই হয় না, তা বলা যাবে না। এখানে অবশ্য আমরা অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনা করব।

ভারতের শ্রমশক্তির প্রায় ৯৪ শতাংশই অসংগঠিত। এই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা সব ক্ষেত্রেই আছেন। ব্যাঙ্ক, বীমা, সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকরা আজ অসংগঠিত। কোথাও চুক্তিভিত্তিক, কোথাও অস্থায়ী, কোথাও নির্দিষ্ট মেয়াদের শ্রমিক। মনমোহনী দাওয়াইতে ১৯৯১ সালে ভারতের অর্থনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটেছিল, যার পোশাকি নাম আর্থিক সংস্কার। নয়া উদারনীতিভিত্তিক সেই সংস্কারের মানে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ, শ্রম সংস্কার, সরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংকোচন, ঠিকা প্রথা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ইত্যাদি। ফলে বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত শ্রমিক তৈরি হল। পুঁজিবাদের সংকট আর তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আরও বেশি মুনাফার সন্ধানে নতুন নতুন বিনিয়োগের জন্য শ্রমিক শোষণ আরো বাড়তে থাকে। কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছে মোদি জমানার শ্রম কোড। দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত শ্রম আইনগুলোকে শুধুমাত্র সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পালটে ফেলা হল, এল চারটে শ্রম কোড। পুরোনো আইনগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের যেটুকু অধিকার ছিল তা ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া হল। এই বিষয়ে বিস্তারিত লেখার স্থান এই আলোচনায় নেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন ফ্যাসিবাদী বিজেপি। বলা ভালো সংঘ পরিবার। এদের প্রধান লক্ষ্য শ্রমিকশ্রেণির সংগঠনকে যেনতেনপ্রকারেণ ধ্বংস করা। তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত এই চারটে শ্রম কোডে। এই প্রেক্ষাপটেই এই আলোচনার সূত্রপাত হওয়া উচিত বলে মনে হয়।

ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের কয়েকটা দুর্বলতাও পরিষ্কার। প্রথমত, সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে বিভক্ত। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকশ্রেণিকে সমসত্ত্ব ভাবে। শ্রমিকদের মধ্যে যে স্তর বিন্যাস আছে তা উপেক্ষিত। তৃতীয়ত, ভারতের প্রেক্ষাপটে শ্রমিকশ্রেণির উপর অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও যে অন্য সামাজিক নিপীড়ন চলে, তা বুঝতে অনেকাংশে ব্যর্থ। যেমন নারী, দলিত,আদিবাসী শ্রমজীবীরা যে সামাজিক নিপীড়নের শিকার, তার জন্য সংগ্রামে অনীহা দেখা যায় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, একশো বছরের উপর সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন নারী শ্রমিকদের দাবিগুলোকে সামনে এনেছে মাত্র এক দশক আগে। চতুর্থত, সংগঠিত ক্ষেত্রে যখন ঠিকা, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে, তখন তাদের সংগঠন গড়তে সেই ক্ষেত্রের সংগঠিত ইউনিয়নগুলো তেমন উদ্যোগ নেয়নি।

অসংখ্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে কয়েকটাকে নিয়ে আলোচনা করা যাক। কলকাতা, বিশেষত উত্তর কলকাতা ও উত্তর শহরতলির বড় অংশ জুড়ে আছে হোসিয়ারি শিল্প। এই শিল্পের মালিকরা বেশি মুনাফার জন্য এই শিল্পকে অসংগঠিত স্তরে রেখেছে। প্রায় আশি শতাংশ উৎপাদনই হয় তিন-চারটে ব্র্যান্ডের মাধ্যমে। এ কাজ করানো হয় ছোট ছোট কারখানার মাধ্যমে। সেখানে শ্রমিক সংখ্যা এমন রাখা হয়, যাতে বড় শিল্পের শ্রমিকদের জন্য যেসব সরকারি নিয়মকানুন আছে সেগুলোকে ফাঁকি দেওয়া যায়, সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা যায়। কোথাও একই মালিকের তিনটে বা চারটে আলাদা আলাদা নামের কারখানা, কোথাও শ্রমিকদের সংখ্যা এক থেকে দশ জনের মধ্যে। গোটা হোসিয়ারি শিল্পক্ষেত্রে অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকদের জন্য শৌচাগার, পানীয় জলের বন্দোবস্ত নেই। যে বদ্ধ ঘরগুলোতে তাঁরা কাজ করেন সেখানে আলো-বাতাস ঢোকে না। এঁদের ন্যূনতম মজুরি এত কম যে শ্রমিকরা দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য হন। এই শিল্প পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ন্যূনতম মজুরি আইনের আওতাভুক্ত। এই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮৯০৪ টাকা থেকে ১০,৭৭৫ টাকার মধ্যে (অদক্ষ, অর্ধ দক্ষ, দক্ষ শ্রমিক অনুযায়ী)। মাঝে মাঝে কারখানাগুলোতে সাসপেশন অফ ওয়ার্ক ঘোষিত হয়। লকডাউনের ফলে এঁদের শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল। দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলে প্রথম লকডাউনের সময়ে এই শিল্পের, বিশেষত নিটিং বিভাগের শ্রমিকরা, বেশিরভাগ কারখানাতেই একমাসের ন্যূনতম মজুরি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক কারখানার শ্রমিকরা সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক চলাকালীন ন্যূনতম মজুরির অর্ধেক আদায় করেছেন। শ্রম কোড বাতিল সহ প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য নিয়োগপত্র, হাজিরা খাতা চালু, মজুরির রসিদ এবং সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে সংগ্রাম চলছে।

এবার আসা যাক ঠিকা মজদুরদের কথায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকানো যাক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয় বললে কম বলা হয়। এঁরা হোস্টেলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য রান্না করেন এবং বাথরুম পরিষ্কার করেন। এই শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয় ঠিকাদারদের মাধ্যমে। লকডাউনের ফলে হোস্টেলগুলো বন্ধ থাকায় ২১ মাস তাঁরা বেতন থেকে বঞ্চিত হন। এঁদের কোনো সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। এ বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এঁদের মজুরি আবার বন্ধ হয়ে গেছে। মজুরি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে মেসে টাকা দিতে না পারায় খাবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ রান্নার কাজ, শৌচাগার পরিষ্কার করার কাজ করে যেতে হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য। ইতিমধ্যেই এই শ্রমিকদের বেশ কয়েকজনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। ধর্না, মিছিল, প্রতিবাদের ফলে মূল নিয়োগকর্তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এঁদের সাথে আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০২২ সালের এক মাসের মজুরি দিতে বাধ্য হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মেস থেকে খাবার দেওয়া আবার চালু হয়েছে। বাকি অধিকারের লড়াই এখনো চলছে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের অবস্থাও একইরকম। দীর্ঘকাল তাঁদের মাইনে বাড়েনি। একেকজন কর্মী বছরের পর বছর কাজ করলেও মাইনে বাড়ে না। পিএফ, ইএসআইয়ের মত সামাজিক সুরক্ষার কোনো বন্দোবস্ত নেই। ঠিকাদারদের সাথে কোনো চুক্তি নেই। এমনকি লকডাউনের সময়ে যাঁরা কাজে এসেছিলেন তাঁদের বেতনও এখনো বকেয়া রয়েছে। এর বিরুদ্ধে কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। বিড়ি শিল্প আর নির্মাণ শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এই দুই শিল্পের এক বিরাট অংশ নারী। দুটো ক্ষেত্রেই ন্যূনতম মজুরি পায় না শ্রমিকরা। নারী শ্রমিকরা ঠিকাদারদের যৌন হেনস্থার শিকার হন। তাঁদের জন্য আলাদা শৌচাগার, ক্রেশ নেই। এমনকি যৌন হেনস্থা নিয়ে এলাকাভিত্তিক যে আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি থাকার কথা, অনেক ক্ষেত্রে তা-ও নেই বা অচল।

আজকের মে দিবসে তাই আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করে শ্রম কোড বাতিলের দাবির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমিক সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। আমাদের সামনে উদাহরণ হিসাবে রয়েছে সংযুক্ত কৃষক মোর্চা। শ্রমিকদের বড় দাবিগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে নারী, দলিত, আদিবাসী আর সংখ্যালঘু শ্রমিকদের দাবিদাওয়াকেও। সামগ্রিকভাবে সর্বস্তরের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন থামিয়ে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখাতে।

মতামত ব্যক্তিগত

আরো পড়ুন

বিড়ি শ্রমিক: যার কাজ আছে তার ভাত নেই

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.