তারা দেবী চন্দননগর গোন্দলপাড়ার শ্রমিক। ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করেছেন। আজও অবসরকালীন পাওনা গণ্ডা পাননি। আদালতের দোরে দোরে ঘুরেছেন কমপক্ষে ১০ বছর। যাঁরা তাঁর প্রাপ্য দেননি তাঁরা সুখে আছেন, যাঁদের আদায় করে দেওয়ার কথা তাঁরাও স্বস্তিতেই আছেন, কেন না মাসের শেষে তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি বেতন পেয়ে থাকেন। আয়লায় সর্বস্ব হারিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁর কয়েকশো মানুষ পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তার কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁদের বুকে যন্ত্রণা আর মুখ দিয়ে রক্তপাত আরম্ভ হয়। অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফেরার পর ডাক্তারবাবুর কাছে জানতে পান তাঁরা সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন, যার কোন চিকিৎসা নেই। গ্রামজুড়ে হাহাকার আর বিলাপ। অসংখ্য মানুষ মারা গেছেন, কয়েকজন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।
ভারতবর্ষ জুড়ে কমপক্ষে দু কোটি শ্রমিক রুজি রোজগারের প্রয়োজনে নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে অন্য রাজ্যে পাড়ি দেন কাজের সন্ধানে। অতিমারীর সময়ে এরকম লক্ষ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিকের পদযাত্রা দেখলাম আমরা। সেইসঙ্গে সংবাদপত্রের পাতায় এবং টিভির পর্দায় দেখা গেল, মৃত মায়ের আঁচল ধরে সন্তান খেতে চাইছে। তারপর বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কোনো আইনানুগ সুব্যবস্থা হয়নি। যাঁরা টিভির পর্দায় এই নির্মম অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র দেখেছিলেন তাঁরাও সম্ভবত ভুলে গেছেন ওই শ্রমিকদের কথা। অথচ ভারতবর্ষের বুকে খনিজ উত্তোলন থেকে শুরু করে গৃহনির্মাণ – যাবতীয় কাজ হয় এই শ্রমিকদের রক্ত আর ঘাম দিয়ে। ইঁটখোলা থেকে পাথর খাদান, রাস্তা নির্মাণ থেকে বহুতল নির্মাণ, সবই হয় মূলত আদিবাসী মানুষের শ্রমশক্তির নির্যাসে। এঁরা আমাদের দেশের সবথেকে হতভাগ্য দরিদ্র মানুষ। তাঁরাই আমাদের দেশের প্রলেতারিয়েত, অর্থাৎ সর্বহারা। এঁদের মাথার উপর ছাউনি বলতে আকাশ। স্বাধীনতা বলতে এঁরা কী বোঝেন?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আরো পড়ুন নয়া দাসত্ববাদে নিষ্পেষিত ভারতীয় শ্রমিক
দেশজুড়ে কৃষক আত্মহত্যা আর কোনো নতুন ব্যাপার নয়। মহারাষ্ট্র থেকে পশ্চিমবঙ্গ – সর্বত্রই অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট সহ্য করে কৃষকরা ভারতবর্ষের ১৪০ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দেন। অভাবের কারণে কৃষকের মৃত্যু আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। আমরা দেখেও দেখি না, বা নিজেদের এইসমস্ত ঘটনা থেকে পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে রেখে মহান ভারতের বীরগাথা নিয়ে আলোচনা করি অথবা ব্যক্তিগত সুখে ভাসতে থাকি। এই উদাসীনতার স্বাধীনতা আমাদের আছে।
আগামী কয়েকদিন সর্বত্র জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হবে, উত্তোলিত হবে জাতীয় পতাকা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রচিত ওই গানটির সবটুকু কি আমরা কখনো মন দিয়ে পড়ে দেখি বা গভীরভাবে তা নিয়ে চিন্তা করি? ওই গানটির এক জায়গায় বলা হয়েছে “নিদ্রিত ভারত জাগে”। কিন্তু নিদ্রিত ভারতবাসী কি সত্যি সত্যিই জেগে উঠেছে? আরেক জায়গায় লেখা হয়েছে “দারুণ বিপ্লব মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে”। সত্যিই কি ভারতবর্ষের বুকে দরিদ্র মানুষের বিপ্লব স্পন্দিত হয়েছে? পঁচাত্তর বছর পার করে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক অদ্ভুত অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে। গোটা দেশে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের যে বিন্যাস সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত তা ভেঙে পড়েছে। স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই মহাত্মা গান্ধীর হত্যার মাধ্যমে ধর্মীয় উন্মাদনা তুঙ্গে উঠেছিল। সময়ের সাথে সেই উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সেই বোতলবন্দি ধর্মীয় দৈত্য বেরিয়ে পড়ল। হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই আক্রান্ত হলেন। সেই আক্রান্ত নাগরিকরা মূলত প্রান্তিক মানুষ।
কেবলমাত্র ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, ভারতবর্ষ জুড়ে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এক নতুন পরিমন্ডল তৈরি করেছে, যা বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিঃস্ব করে ফেলছে আর দুর্নীতির মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠছে এই দেশ। এই দুর্নীতির সূচনা হয়েছিল অর্থের বিনিময়ে জনপ্রতিনিধি ক্রয় বিক্রয়ের মধ্য দিয়ে। এখন এই দুর্বৃত্তায়নের আবর্তে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামরিক দপ্তর, প্রশাসনিক দপ্তরসহ সবকিছুই।
অন্যদিকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় সংকট হল পরিবেশ সংকট। সেখানেও আজ দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের সীমাহীন আত্মপ্রকাশ। ভারতের সমস্ত নদী দূষণে কলুষিত, বনাঞ্চল নির্মমভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, সমুদ্রসৈকতও অবাঞ্ছিত কার্যকলাপে ক্ষতিগ্রস্ত। ১৯৭২ সালের পর থেকে ভারতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে বহু আইন তৈরি হয়েছে কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ সংক্রান্ত আইন কার্যকর না করে বরং সেই আইনগুলোর পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশজুড়ে পরিবেশ বিরোধী কাজকর্মে ইন্ধন দিচ্ছে এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে নির্বিচারে জল, জঙ্গল এমনকি সমুদ্রতটও ধ্বংস করার অনুমতি দিচ্ছে। করোনাকালে সবার অজান্তে পরিবেশ আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। ঘটা করে নমামি গঙ্গে প্রকল্প চালু করে গঙ্গারতির মধ্য দিয়ে গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার পরিকল্পনা ঘোষণা হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। করোনার সময়ে গঙ্গার জলে ভেসে গেল অসংখ্য মৃতদেহ। তবু পরিবেশকর্মীরা তাঁদের সীমিত ক্ষমতা নিয়েই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবেশবিরোধী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। এই লড়াই স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীনতা পাওয়া পর থেকে দেশের মানুষ বহু ধরনের দুর্নীতি দেখেছেন, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে যে ধরনের দুর্নীতির ছবি বা খবর ইদানীং খবরের কাগজের পাতায় কিংবা টিভির পর্দায় ফুটে উঠছে, সে ছবি অনেকেরই কল্পনাতীত।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির মুখে দাঁড়িয়ে এ কথা নিশ্চিত, এই সাড়ে সাত দশকে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে যাতে দেশের মানুষের কিছু লাভ হয়েছে। যেমন ব্যাঙ্ক এবং জীবনবীমা জাতীয়করণ, প্রাকৃতিক সম্পদের জাতীয়করণ, শ্রমজীবী মানুষের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি প্রকল্প, ১০০ দিনের কাজের পরিকল্পনাসহ শিক্ষার অধিকার ভারতের মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। খাদ্য সুরক্ষা আইনে মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তির দায় রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত হয়েছে। কিন্তু.সাম্প্রতিককালে কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিভিন্ন শাসকদল এই সমস্ত জনহিতকর প্রকল্পগুলো অনেকটাই পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছে। খোদ সুপ্রিম কোর্ট বলছে জনকল্যাণকর প্রকল্পগুলো নাকি দান খয়রাতি, যা দেশের আর্থিক ক্ষতি করছে। মানুষের মাথার উপর ছাদ বা স্থায়ী গৃহের অধিকার আজ সংবিধানস্বীকৃত। সে ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ প্রকল্পগুলোকে অনেকাংশে মলিন করে দিয়েছে। মানুষ অবশ্য, দেরিতে হলেও, প্রতিবাদ করছেন ন্যায্য অধিকার পাওয়ার জন্য।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।