ডিসেম্বর মাসে কর্ণাটকের উদুপির গভর্নমেন্ট পিইউ কলেজের কর্তৃপক্ষ হঠাৎ হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। প্রতিবাদে কিছু ছাত্রী কলেজের গেটে মাথায় হিজাব পরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করল। তারা হাইকোর্টেও একটি রিট পিটিশন দায়ের করল। এরপর ওই জেলার বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাসে গেরুয়া উত্তরীয় পরা কিছু ছাত্র এবং বহিরাগত হিন্দুত্ববাদীদের দাপাদাপি এবং “জয় শ্রীরাম” চিৎকার শুরু হয়ে গেল। সম্প্রতি একটা ভিডিও গোটা উপমহাদেশে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওয় মান্দ্যা পিইউ কলেজের এক ছাত্রীকে নিকাব পরে কলেজে ঢোকার সময় উন্মত্ত গেরুয়া বাহিনীর মুখোমুখি হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা ভয় পেল না, “জয় শ্রীরাম” স্লোগানের প্রত্যুত্তরে সেও ‘“আল্লাহু আকবর” আওয়াজ তুলল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আচরণ, হিজাব, পাগড়ি, তিলক, জয় শ্রীরামের পাল্টা আল্লাহু আকবর? নাকি জয় হিন্দ বা জয় ভীম? পর্দা ও নারী স্বাধীনতা — এমন নানান বিষয়ে সংসদ থেকে সোশাল মিডিয়া, সর্বত্র নানা ভিন্নধর্মী মতামত গোটা দেশের মানুষ প্রকাশ করছেন। কেউ ইসলামিস্ট, কেউ ইসলামোফোবিক, কেউ ফেমিনিস্ট, কেউ হিউম্যানিস্ট, কেউ সেকুলারিস্ট, কেউ নাস্তিক, কেউ হিন্দুত্ববাদী, কেউ যুক্তিবাদী। সবাই নিজের অবস্থান থেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে মতামত দিচ্ছেন। তাদের মতামতের ভিন্নতা স্বাভাবিক এবং তাদের কাউকে খণ্ডন করার প্রয়োজন বোধ করে এই নিবন্ধটি লেখা হয়নি। আমি একজন মার্কসবাদী এবং এই প্রেক্ষিতে একজন মার্কসবাদীর কী অবস্থান হওয়া উচিত, তা নিয়েই এই আলোচনা।

মার্কসবাদ ও ধর্ম

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

“ধর্ম হচ্ছে জনগণের জন্য আফিম” — এই বিখ্যাত উক্তিটা ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের চূড়ান্ত মূল্যায়ন হিসাবে বহুল প্রচারিত। যাঁরা মার্কস পড়েননি তাঁরা, যাঁরা মার্কস পড়ে বোঝেননি তাঁরা এবং যাঁরা মার্কস পড়ুন বা না পড়ুন, বিরোধিতা করতে চান, তাঁরা — সকলেই এই বাক্য জানেন এবং বলেন। কিন্তু মার্কস ধর্ম সম্পর্কে যা বলেছেন তা এই একটা বাক্যে সীমায়িত করলে তা হবে অন্ধের হাতি দেখা। অন্যদিকে এই বাক্যটাকেই ভিত্তি করে মার্কসের অনুগামীদের একাংশ বিপ্লববাদে ডানা মেলতে চান। কিন্তু তাঁদের বলি, মার্কস কখনো এ ধরনের কথা বলেননি যে ধর্ম শাসকশ্রেণীর হাতিয়ার, যা ব্যবহার করে তারা শ্রমজীবী মানুষকে শান্ত রাখতে চায়।

দি ইন্ট্রোডাকশন টু এ কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ হেগেলস্ ফিলোসফি অফ রাইট শীর্ষক লেখায় ধর্ম নিয়ে আলোচনার শুরুতেই মার্কস বিনয়ের সাথে বলেছেন যে ধর্ম নিয়ে প্রয়োজনীয় সমালোচনার কাজ কার্যত সম্পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ মার্কসের আগেই প্রকৃতি বিজ্ঞানের অগ্রগতি, ফয়েরবাখ ও অন্য নব্য হেগেলীয়দের ধর্ম নিয়ে সমালোচনা ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করেছে এবং সঠিকভাবেই তা করেছে। তাই “মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করেছে, ধর্ম মানুষকে সৃষ্টি করেনি” — এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা না করে এখান থেকে মার্কস তাঁর কথা শুরু করেন। অতএব ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ধর্মের সারবত্তা নিয়ে একজন আধুনিক যুক্তিবাদীর সাথে একজন মার্কসবাদীর কোন মতের অমিল নেই। কিন্তু একজন মার্কসবাদী সেখানেই থেমে থাকে না, বরং সেখান থেকেই আরো সামনের দিকে এগিয়ে যায়। যে কোনো মার্কসবাদীকে এটা বুঝতে হয় যে ধর্মের উদ্ভব হয় মানুষেরই সমাজে, এই সমাজের গভীরে প্রোথিত শিকড় থেকে ধর্ম তার টিকে থাকার রসদ জোগাড় করে। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থাটাই এমন যে বাস্তব জগৎটা মানুষের কাছে উল্টো। মানুষ তার বিজ্ঞানকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে প্রায় কোনো শারীরিক রোগই তার কাছে দুরারোগ্য নয়, অথচ সামান্য রোগেই সে তার প্রিয় সন্তানকে চিকিৎসাহীন মারা যেতে দেখে; কৃষক এত বেশি উৎপাদন করে যে ফসল বিক্রি করতে না পরে সে নিজেই অপুষ্টির শিকার হয়; তারই শ্রমে উৎপন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হয়ে ক্রয়ক্ষমতাহীন উৎপাদক শ্রমিকের বধূ শ্রমিকের উপরই অভিমানী হয়ে ওঠে। ধর্ম হল এই উল্টো জগতের সাধারণ তত্ত্ব, এর জনপ্রিয় যৌক্তিক ব্যাখ্যা, এর মানবিক অনুমোদন। সেই কারণে মার্কস বললেন, ধর্ম হলো মানুষের উল্টানো জগৎ চেতনা। সেই অসাধারণ রূপকধর্মী পংক্তি, যা দিয়ে মার্কস তাঁর লেখা শেষ করেছেন, তা হল:

“ধর্ম হল নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, এক হৃদয়হীন জগতের হৃদয়। ধর্ম জনগণের জন্য আফিম।”

কিন্তু ধর্মীয় যন্ত্রণা একই সাথে মানুষের বাস্তবিক জীবনযন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ এবং সেই যন্ত্রণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও বটে। তাই ইতিহাস সাক্ষী অসংখ্য প্রতিবাদী, যুক্তিপূর্ণ, এমনকি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যা সংঘটিত হয়েছে ধর্মীয় আঙ্গিকে। কিন্তু সেই কারণেই মার্কসবাদীরা নিছক যুক্তিবাদীদের মতো একবগ্গা ধর্মবিরোধী প্রচার থেকে নিজেদের বিরত রাখে তা নয়। আসলে মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করে, ধর্মের কাল্পনিক সুখবিলাস থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হলে বিকল্প বাস্তবিক সুখের সন্ধান তাকে দিতেই হবে। সেজন্য এই শোষণমূলক সামাজিক সম্পর্কের অবসান ঘটাতে হবে। যে কারণে ধর্ম টিকে থাকে, সেই কারণকে অপসারণ না করে কেবলমাত্র নাস্তিকতা বা যুক্তিবাদের প্রচার করে জনগণের চেতনা পরিবর্তন করার চেষ্টা কোন মার্কসবাদী কর্মসূচি হতে পারে না। বরং সমাজ পরিবর্তনের যে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শোষিত জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটানোর লক্ষ্যে মার্কসবাদীরা এগোতে চায়, সে ধরণের কার্যকলাপ তাদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এটা নিছক সাময়িক কৌশল নয়, মার্কসবাদীদের ধারাবাহিক অবস্থান। ব্ল্যাঙ্কুইস্টদের প্রস্তাব ছিল, তাদের কাঙ্ক্ষিত পারি কমিউনে কোন পাদ্রীর প্রয়োজন নেই, সেখানে সমস্ত ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মীয় প্রদর্শন নিষিদ্ধ হবে। ১৮৭৪ সালেই এঙ্গেলস এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেছিলেন, “অনভিপ্রেত বিশ্বাসকে প্রোমোট করার শ্রেষ্ঠ পন্থা হল বিশ্বাসীর উপর নির্যাতন”। কথাটি বর্তমান বিতর্কে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। শ্রমিকশ্রেণির দ্বারা সংঘটিত বিপ্লবের আগে এবং বিপ্লবের পরেও মার্কসবাদীরা ব্যক্তি নাগরিকের ধর্মবিশ্বাসে কোনরকম হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধী। ধর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা দূরের কথা, লেনিন ১৯০৫ সালে ‘স্যোসালিজম অ্যান্ড রিলিজিয়ন’ নিবন্ধে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রেও নাগরিকের ধর্মবিশ্বাসের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করে লিখেছেন:

“ধর্ম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত কোনো বিষয় হবে না, এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সরকারি আধিকারিকদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। আইনানুসারে প্রত্যেকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন থাকবে যে কোনো ধর্ম যা সে বিশ্বাস করে তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে, অথবা কোনো ধর্মেই যদি তার বিশ্বাস না থাকে সেক্ষেত্রেও। কোনোভাবেই নাগরিকদের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে কোনো প্রভেদ করা যাবে না। এমনকি সরকারি নথিতে কোনো নাগরিকের ধর্মের কোনো উল্লেখ প্রশ্নাতীতভাবে নিষিদ্ধ হবে।”

মার্কসবাদ হল এই জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। স্বভাবতই একজন মার্কসবাদী ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণে একজন নাস্তিক। শুধু তাই নয়, শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট জনগণকে অশিক্ষা, ধর্মীয় কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোকময় আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে উত্তরণ করানোর কর্মসূচি কোনোভাবেই একজন মার্কসবাদী এড়িয়ে যেতে পারে না। একইসঙ্গে মার্কসবাদীরা রাজনৈতিকভাবে আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষ, অর্থাৎ রাষ্ট্রের অধীনে নিজের ধর্মে বিশ্বাস না করার অধিকার এবং অন্যের ধর্মে বিশ্বাস করার অধিকার রক্ষার বিষয়ে সোচ্চার।

সেকুলারিজম

সেকুলারিজম একটি আধুনিক শব্দ। ইউরোপের নবজাগরণ প্রথম রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসাবে সেকুলারিজমের যে মডেল হাজির করে তার অর্থ — একজন নাগরিক নাস্তিক, ডীইস্ট (যাঁরা ঈশ্বরকে স্রষ্টা বলে মানেন, কর্তা বলে মানেন না) বা ধর্মবিশ্বাসী যা খুশি হতে পারেন, রাষ্ট্রের সে বিষয়ে কিছু বলার নেই। ইউরোপের উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল এই সেকুলারিজমের পতাকা বাহক। তখন চার্চ ছিল সামন্ততন্ত্রের অন্নভোগী এবং জনমানসে সামন্ততন্ত্রের বৌদ্ধিক রক্ষক। সামন্ততন্ত্রকে নির্মূল করতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর চার্চের প্রভাব খর্ব করা আশু প্রয়োজন ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে সামন্তশ্রেণিকে নির্মূল করার পর বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে চার্চের বৈরিতা ক্রমশ ক্ষীণ হয়। চার্চ তার পুরনো অবস্থান থেকে সরে আসে। ক্যাপিটালের প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধে চার্চের এই ভূমিকা নিয়ে মার্কস লিখেছেন, “প্রতিষ্ঠিত চার্চগুলি তাদের উনত্রিশটি বিধানের মধ্যে আঠাশটি বিধানের অবমাননা সহ্য করবে, কিন্তু উনত্রিশ ভাগের এক ভাগ আয় কমে যাওয়াটা ক্ষমা করবে না।” একদিকে চার্চের এই অবস্থান পরিবর্তন, অন্যদিকে সামন্ততন্ত্রের চ্যালেঞ্জ না থাকা, এই দুই কারণে বুর্জোয়া শ্রেণি চার্চের প্রতি তার পুরনো বৈরিতা থেকে সম্পূর্ণ সরে আসে। ইউরোপ ও আমেরিকা সেকুলারিজমের দৃঢ় অবস্থান থেকে সরে এসে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক আপসকামী ধর্মনিরপেক্ষতার আশ্রয় নিতে শুরু করে।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার যে নীতি গ্রহণ করে তা মোটেই দৃঢ় সেকুলারিজম নয়। এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হয়ে দাঁড়াল রাষ্ট্র কর্তৃক সব ধর্মের স্কীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা। এর কারণ ভারতের নতুন শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি সামন্ততন্ত্র ও তার সামাজিক, বৌদ্ধিক ভিত্তিকে ধ্বংস না করে তাদের সাথে আপস বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে চেয়েছিল । বলা বাহুল্য, মার্কসবাদীরা সদ্য স্বাধীন ভারতের শাসক শ্রেণি ও তাদের এই আপসকামী সেকুলারিজমের আদর্শের তীব্র বিরোধী ছিল।

গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী কয়েকটা দশকে মানুষ এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছিল। তখন পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশে উড়ছে সমাজতন্ত্রের পতাকা, যেখানে ধর্ম নিছকই কিছু নাগরিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের জোয়ার, সারা পৃথিবী আলোড়িত প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে। বিশ্ব পুঁজিবাদ তখন গাঁটছড়া বাঁধে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর সাথে, যাদের আশ্রয় ছিল ধর্ম। শতাব্দীর শেষ পর্বে এসে পূর্ব ইউরোপসহ সোভিয়েতের পতন হল, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনুন্নত বিশ্বে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কাছে প্রগতিশীল আন্দোলনের পরাজয় ঘটল, সাময়িক হলেও পিছু হটল সমাজতান্ত্রিক শিবির। প্রযুক্তিতাড়িত বিশ্বায়নের যুগে ধর্ম এখন কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, রাজনীতির অন্যতম প্রধান উপাদান। বর্তমান সময়ে বুর্জোয়ারা যখন তাদেরই একদা পছন্দের সেকুলারিজমের পতাকা পদদলিত করে এগোতে চাইছে, একজন মার্কসবাদীর দায়িত্ব তাদের ফেলে দেওয়া সেকুলারিজমের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরা।

সমকালীন বিশ্ব

সোভিয়েত পরবর্তী একমেরু বিশ্বে গোটা দুনিয়াটাই এখন বৃহৎ পুঁজির মৃগয়াক্ষেত্র। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলেছিলেন ন্ড অফ হিস্ট্রি, অর্থাৎ বিশ্বায়িত নিঃস্বায়নের জাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সামনে শোষণহীন সমাজের স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ১৯৯৩ সালে আমেরিকান দক্ষিণপন্থী লিবারেল বুদ্ধিজীবী স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর দ্য ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশনস বইতে লেখেন “নতুন এই বিশ্বে আগামী সংঘাতগুলি আদর্শ বা অর্থনীতির কারণে হবে না, হবে সাংস্কৃতিক কারণে। মানুষে মানুষে পার্থক্য ও সংঘাতের কারণ হবে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। বিভিন্ন সভ্যতার পারস্পরিক পার্থক্যের রেখাগুলিই হবে আগামীর যুদ্ধরেখা।” কাকতালীয় হলেও পরবর্তী তিন দশকের বিশ্ব রাজনীতি হান্টিংটনের দেখানো পথেই এগিয়েছে। শ্রেণিসংগ্রামের বিকল্প হিসাবে ধর্ম-সংস্কৃতির সংঘাত দক্ষিণপন্থীদের এক নিরাপদ ও পছন্দের প্রকল্প। বিপরীতক্রমে, জনগণের ঐক্য বিনষ্টকারী এই কৃত্রিম সংঘাতের আবর্ত থেকে শোষিত মানুষকে মুক্ত করে শ্রেণিসংগ্রামকে তীব্র করা মার্কসবাদীদের লক্ষ্য।

ইসলামিক দেশগুলোতে ধর্মই রাষ্ট্রের এক প্রধান স্তম্ভ। প্রাক-ঔপনিবেশিক ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা দাঁড়িয়েছিল দুটো স্তম্ভের উপর — উলেমাতন্ত্র ও বাদশা। বুর্জোয়া বিপ্লব পূর্ববর্তী ইউরোপে অনুরূপ ভূমিকায় ছিল যাজকতন্ত্র ও রাজা। বুর্জোয়া শ্রেণির হাত ধরে ইউরোপে যাজক, সামন্তদের প্রভুত্বের অবসান ঘটেছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সেই ইউরোপিয় বুর্জোয়া শ্রেণির মানদণ্ডই একদিন ইসলামিক দুনিয়ার রাজদণ্ডে পরিণত হল। কিন্তু যেমনটা লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে করেছিল, মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা তেমনটা করল না। ঔপনিবেশিক শোষণের জন্য এখানে তারা স্থানীয় ধর্মের উপরই নির্ভর করল। ফলে উলেমাতন্ত্র টিকে গেল এবং সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে থাকল, যেমনটা তারা ঠান্ডা যুদ্ধের পর্বেও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা হয়েছে।

আজকের ইসলামিক দেশগুলির শাসকশ্রেণির মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্য (যেমন শিয়া ও সুন্নি) সত্ত্বেও তারা সকলেই জনগণের নিদারুণ দুঃখ দারিদ্র্যের কারণ হিসাবে ইসলামের আদি আদর্শ থেকে বিচ্যুতিকেই চিহ্নিত করে। তারা প্রত্যেকেই ওই দেশগুলোতে বিদ্যমান নিপীড়নমূলক সামন্ততান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে রক্ষা করতে চায় এবং এগুলোকে আরও বেশি ইসলামসম্মত তকমা দেয়। ওইসব দেশের দরিদ্র জনসাধারণের বড় অংশই এটা ভাবতে বাধ্য হয় যে কোরান ও সুন্নার বিধানে ফিরে যাওয়াই আধ্যাত্মিক পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। একাংশের নারীর কাছে হিজাব এই পিতৃতান্ত্রিক ভাবধারার ধর্মীয় বিধান, যা মান্য করাটা তাদের আধ্যাত্মিক পরিত্রাণের একটা উপায়। যে সামাজিক কাঠামোতে এই পরিত্রাণপন্থা তাদের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে সেই কাঠামোকে না ভেঙে নারীমুক্তির একমাত্র পন্থা হিসাবে হিজাবের বিরোধিতা করলে তা খুব একটা কার্যকরী হয় না। তার অর্থ এই নয় যে হিজাবকে আইনত বাধ্যতামূলক করে তুলে ইসলামিক দেশগুলোতে যখন অনিচ্ছুক নারীদের উপর জোর করে সেই পোষাক বিধি চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং ওই সমাজের ভিতর থেকেই যখন সেই নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়, মার্কসবাদীরা সেই আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। বছর পাঁচেক আগে ইরানের সাংবাদিক মাসিহ আলিনেজাদ ইরানের পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর হিজাবহীন ছবি স্যোসাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন এবং অন্য মহিলাদের উৎসাহিত করেন এমন গোপন স্বাধীন মুহূর্তের ছবি পোস্ট করতে। #mystealthyfreedom হ্যাশট্যাগে অসংখ্য হিজাবহীন সেলফি পোস্ট হয়। আলিনেজাদকে দেশ ছাড়তে হয়, এখনো প্রতিদিন তাঁকে খুনের হুমকি শুনতে হয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তেহরানের রাজপথে বাধ্যতামূলক হিজাবের আইন অমান্য করে ২৯ জন মহিলা গ্রেফতার হন। মার্কসবাদীরা যেহেতু ধর্মীয় বিধান মানা এবং না মানা, উভয় স্বাধীনতার পক্ষে, ইসলামী দুনিয়ার বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রতিবাদ আন্দোলনকে তারা পূর্ণ সমর্থন করে।

১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, উত্তর ফ্রান্সের এক স্কুলে তিনজন মুসলিম ছাত্রী হিজাব পরে স্কুলে আসায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সাসপেন্ড করে। বিতর্কের সূত্রপাত তখন থেকেই। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে ফরাসি পার্লামেন্টে ভোটাভুটি করে আইন পাশ করা হয়, কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো ধর্মীয় পরিচয়বাহী পোশাক পরে আসতে পারবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের কথা মাথায় রেখে অনেক নারীবাদী, প্রগতিশীল, বামপন্থী এই আইনের সমর্থনে দাঁড়ান। একজন মার্কসবাদীর অবস্থান এক্ষেত্রে কি হওয়া উচিত? মার্কসবাদীরা নাগরিকের ধর্মে বিশ্বাস করা এবং না করা — দুটো অধিকারেরই পক্ষে এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তাই যে কারণে মার্কসবাদীরা ইরানের বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের বিরোধিতা করে, সেই কারণেই ফ্রান্সের বাধ্যতামূলক হিজাবহীনতার বিরোধিতা করে। এ কথাও মার্কসবাদীরা জানে, অনভিপ্রেত বিশ্বাস প্রচার করার শ্রেষ্ঠ পন্থা হল বিশ্বাসীর উপর নির্যাতন। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে ঠিক সেই ঘটনাই ঘটেছে। হিজাব নিষিদ্ধ হবার পর ফ্রান্সে নতুন করে অনেক ইসলামিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, অনেক ছাত্রী স্কুল ছেড়ে বাড়ি থেকে পড়াশোনা করার চেষ্টা চালাচ্ছে, কোনো কোনো ছাত্রী চুল ঢাকার নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে মস্তক মুণ্ডিত করে স্কুলে যাচ্ছে। যাদের পক্ষে সম্ভব, তারা ফ্রান্স ছেড়ে চলে গেছে। সেকুলারিজমের দোহাই দিয়ে একাংশের নাগরিককে বিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে বিদায় দেবার আইন আর যা-ই হোক সার্বিকভাবে সমাজের পক্ষে প্রগতিশীল বলা যায় না।

বর্তমান ভারত

যেভাবে আমেরিকা ও ইউরোপের সংখ্যাগুরুরা মুসলমানবিদ্বেষে আক্রান্ত, ভারতের প্রেক্ষিতটা তার থেকে ভিন্ন। এর সূত্রপাত উপনিবেশবাদীদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির মধ্যে দিয়ে। এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ইতিহাস তুলনামূলকভাবে পুরনো এবং সমাজের গভীরে তার শিকড়। দেশভাগের পর এদেশের বৃহৎ বুর্জোয়ারা যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা বলেছিল তার গোড়াতেই যে গলদ ছিল, তা আগেই উল্লেখ করেছি। এখন সংখ্যাগুরু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা। সারা পৃথিবীতেই সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মডেল হল সংখ্যালঘুর শক্তিবৃদ্ধি ও সামর্থ সম্পর্কে সংখ্যাগুরুর মনে মিথ্যা আতঙ্ক সৃষ্টি। ইসলামোফোবিয়ার ভারতীয় ভাষ্য হল “হিন্দু খতরে মে হ্যায়”।

একদিকে কর্পোরেট পুঁজি দেশের জল, জমি, আকাশ সব লুঠ করবে, অন্যদিকে জনগণের তীব্র দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, বেকারত্ব — সবকিছুর জন্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দায়ী করা হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচরণ, পোষাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সংখ্যাগুরুর মনে বিদ্বেষ, সন্দেহ, ঘৃণা সৃষ্টি করে তাকে আক্রমণাত্মক করে তোলা হবে। দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে, নানান বিদ্বেষমূলক আইন প্রণয়ন করে সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার নামিয়ে আনা হবে। আর এইসব কাজে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হবে। অপরদিকে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মসীহা হিসাবে অবতীর্ণ হয়ে সেই সমাজের সমস্ত প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে সংখ্যালঘুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। বিজেপির শাসনে গত আট বছর ধরে একের পর এক এই কাজগুলোই করা হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে হিজাব নিষিদ্ধ করা সেইরকমই একটা হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। যারা শিক্ষাঙ্গন থেকে সংসদ সর্বত্র ধর্মীয় রীতিনীতি প্রবর্তন করতে চায়, তাদের এই হিজাববিরোধী আন্দোলনে যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান খুঁজে পাচ্ছেন, তাঁরা নাস্তিক্যবাদী, যুক্তিবাদী, নারীবাদী যা খুশি হতে পারেন। মার্কসবাদী নন।

মতামত ব্যক্তিগত

আরো পড়ুন

হিজাব নিয়ে মামলা: ভারতীয় বিচারব্যবস্থার আরেকটি পরীক্ষা

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.