গুজরাট আর হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের কদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি পুর নিগম নির্বাচনের ভোটের ফলাফল। দেড় দশক পরে ওই পুর নিগম হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির। বিরোধী হাওয়ার ফায়দা তুলে ১৩০-এরও বেশি আসন নিয়ে রাজধানীর পুর নিগম দখল করেছে আম আদমি পার্টি বা আপ। হারলেও অবশ্য মুছে যায়নি বিজেপি, তাদের দখলে শতাধিক আসন। বিধানসভার তুলনায় ভোট বাড়লেও ক্লাসের লাস্ট বয় কংগ্রেস। মাত্র নটি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের।

এই ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিক কূটকচালির সম্ভাবনা কম। কারণ গুজরাট আর হিমাচল প্রদেশ ছাড়াও দেশের একাধিক লোকসভা ও বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনের ফল বেরিয়েছে। সেসবের মাঝে দিল্লি পুর নিগমের লড়াইকে নিরামিষই বলা চলে। রাজনীতির পাঠক্রমে সদ্য হাতেখড়ি হওয়া ছাত্রছাত্রীরাও জানে হয় আপ না হয় বিজেপি – হয় উগ্র হিন্দুত্ব নয় তো ধুপ-ধুনো-চণ্ডীপাঠ অথবা লক্ষ্মী-গণেশ আর নামাবলী – রাজধানীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এরই মধ্যে ঘোরাফেরা করবে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তবু এই আপাত নিরামিষ সংঘাতই মনে রাখতে হবে কিছু টুকরো-টাকরা বিষয়ের জন্য। ২০২০ সালের ভয়াবহ দাঙ্গা আর ২০২২ সালে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে বুলডোজারে নিজের সম্পত্তি-দোকান-বাজার গুঁড়িয়ে যাওয়ার স্মৃতি সম্বল করে ভোট দিল উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিল্লি। জাহাঙ্গিরপুরীর ভয়াবহ সেসব দিন স্মরণ করেই ভোট হল। সাধারণভাবে দিল্লি পুর নিগমের নির্বাচনে খুব বেশি ভোট পড়ে না। এবারেও ৫০% ভোট পড়েছে। অভিজাত দক্ষিণ দিল্লিতে ভোটদানের হার আরও কম। উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিল্লির দাঙ্গাবিধ্বস্ত অংশে বরং বেশি ভোট পড়েছে।

২০২২ সালের এই নির্বাচন থেকে তাহলে মনে রাখার মত কী কী পেল রাজনীতির ছাত্রছাত্রী এবং প্রাজ্ঞ দর্শকরা? দেখে নেওয়া যাক।

দিল্লির পুর নির্বাচনে পরাজয়ের মুখোমুখি হল ভারতীয় জনতা পার্টি। টানা পনেরো বছর পরে ক্ষমতা হারাল দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। পরাজিত হলেও বিজেপির কিছু সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কপালে ভাঁজ ফেলবে। তার একটি হল পসমন্দা কার্ড।

ফারসী ভাষায় ‘পসমন্দ’ শব্দের অর্থ হল ‘পিছিয়ে পড়া’। ভারতীয় মুসলমানদের এক বড় অংশ এই পসমন্দা সমাজের অংশ। বলা যায় ভারতীয় মুসলমানদের গরিষ্ঠ অংশই আসলে পসমন্দা মুসলমানদের মধ্যে পড়েন। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়া এই অংশ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমান প্রতিনিধিত্বের দাবি করে আসছেন।

ভারতীয় মুসলমান সমাজে মূলত তিনটি বিভাজন আছে। আশরফ – মুসলমান সমাজের সবথেকে অভিজাত অংশ। খান, সৈয়দ, পাঠান পদবির অনেকে দাবি করেন তাঁদের শিকড় ছিল মধ্যপ্রাচ্যে। এঁরাই মুসলমান সমাজের ‘খানদানি’ অংশ। এরপর রয়েছেন আজলফরা। মুসলমানদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষকে নিয়ে তৈরি আজলফদের কিছু অংশ পসমন্দার অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় গোষ্ঠীটি হল আরজল। মুসলমান সমাজের গরিষ্ঠ অংশ এঁরাই। এককথায় এঁরা দলিত মুসলমান – পসমন্দা সমাজের মূল ভিত্তি।

২০০৬ সালের সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় মুসলমানদের ৪০ শতাংশই আদপে পিছিয়ে পড়া মুসলমান। যা দেশের মোট পিছিয়ে পড়া জনসংখ্যার ১৬ শতাংশের কাছাকাছি। পসমন্দা মুসলমানদের এক বড় অংশের দাবি ওবিসি কিংবা এসসি, এসটি সংরক্ষণের সুযোগ। ত্রিধাবিভক্ত মুসলমান সমাজের মধ্যে আশরফদের ভিড়ে তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না, এমন দাবিও তাঁরা করে থাকেন।

১৯৯৮ সালে প্রথমবার বিহারের রাজনীতিতে পসমন্দা কথাটা শোনা যায়। দলিত-ওবিসি মুসলমানদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামেন পসমন্দা মুসলিম মহজের নেতা আলি আনওয়ার আনসারি।

ভারতীয় রাজনীতির অলিগলিতে যাঁরা অল্পবিস্তর ঘোরাঘুরি করেছেন তাঁরা জানেন, গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় ওবিসি-দলিত আন্দোলনের প্রভাবের কথা। ওবিসি আন্দোলন এখন বিজেপির আস্তিনের মূল তাস। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীকে ওবিসি হিসাবে প্রচার করা অথবা ২০১৭ এবং ২০২২ সালে সমাজবাদী পার্টির যাদব ও মুসলমান ভোটব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে সমস্ত ওবিসিদের এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার চেষ্টা – বিজেপি মজেছে ওবিসিতেই। জাতপাতের ভিত্তিতে বিভক্ত হিন্দু সমাজের এক বড় অংশের মধ্যে ভিত তৈরি করার পাশাপাশি বিজেপি মুসলমান সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের দিকেও হাত বাড়িয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাই – “মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক” আঞ্চলিক দলগুলোর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া। এ কাজে তাদের লক্ষ্য ছিল ওবিসি এবং দলিত মুসলমানরাই।

ক্ষমতা দখলের লড়াই বা ভারতের প্রেক্ষিতে কংগ্রেস ঘরানার বিপ্রতীপে থাকা যে কোনো রাজনৈতিক লড়াই আসলে ‘অপর’-এর বিরুদ্ধে লড়াই। কাকে অপর বলে, বিজেপি সেই ধারণা বদলে দিচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে অ-যাদব সমস্ত ওবিসি জনজাতির বিরুদ্ধে অপর হয়ে উঠছে যাদবরা। এদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের যুগে ব্রাত্য হয়ে থাকা মুসলমান সমাজের মধ্যেও অপর তৈরির চেষ্টায় আছে বিজেপি। সামাজিকভাবে অপর আশরফরা। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধারক ও বাহক বিভিন্ন দলকেও গরিষ্ঠ মুসলমানদের থেকে বিচ্ছিন্ন প্রমাণ করে অপরের তকমা দিতে চাইছে বিজেপি।

কিন্তু দিল্লি নির্বাচনে এই পসমন্দা কার্ড কি খাটল? চলতি নির্বাচনে চৌহান বাঙ্গার থেকে দাঁড়িয়েছিলেন শাবা গাজি। ২০২০ এবং ২০২২ সালের দাঙ্গা জর্জরিত এই ওয়ার্ডে জামানত খোয়ালেন তিনি। কংগ্রেসের শাগুফতা চৌধুরীর কাছে ১৫ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরেছেন শাবা। চাঁদনি মহল থেকে দাঁড়ানো ইরফান মালিকের হাল আরও শোচনীয়। তাঁর পরাজয়ের ব্যবধান ১৮ হাজারের বেশি। মুস্তাফাবাদ এবং কুরেশ নগরের বাকি দুই পসমন্দা প্রার্থীর একজন জমানত বাঁচালেন মাত্র দু ভোটে। একজন হারলেন ৬,৬০০-র বেশি ভোটে।

পসমন্দা প্রার্থীদের পরাজয় আপাতভাবে মুসলমান সমাজে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতার তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছে। তবে বিজেপি গ্রহণযোগ্যতা হারালেও সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে কংগ্রেস কিন্তু পুর নির্বাচনে মুসলমানদের সমর্থন কিছুটা ফেরত আনতে পেরেছে বলা চলে।

আরো পড়ুন প্রতিবাদে মুখর ছাত্ররা মুসলিম সমাজে নতুন আশার আলো

চলতি নির্বাচনে নটি আসনে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস, যার মধ্যে ছটিতেই মুসলমান ভোটারদের আধিক্য। চৌহান বাঙ্গার থেকে কংগ্রেস প্রার্থী শাগুফতার জয়ের ব্যবধান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এছাড়া মুস্তাফাবাদে শাবিলা বেগম, আবুল ফজল এনক্লেভে আরিবা খান, জাকির নগরে নাজিয়া দানিশ, শাস্ত্রী পার্কে সমীর আহমেদ এবং কবীর নগরে জারিফ। চৌহান বাঙ্গার, মুস্তাফাবাদ ও আবুল ফজল এনক্লেভে এর আগে নির্বাচিত হয়েছিলেন আপের পদপ্রার্থীরা। ছটি ওয়ার্ডই দাঙ্গাবিধ্বস্ত। দেশের অন্যান্য প্রান্তে আঞ্চলিক দলগুলো যেখানে মুসলমান ভোট পাওয়ার ব্যাপারে চালকের আসনে, দিল্লি পুর নিগম সেখানে অন্তত ছটি ক্ষেত্রে বিপরীত অবস্থান নিয়েছে এমনটা বলাই যায়।

কিন্তু কেন এই উলটপুরাণ? কানাঘুষো শোনা যায়, গুজরাট-হিমাচল-দিল্লিকে নিশানা করে আপের লক্ষ্মী-গণেশ-নামাবলীর রাজনীতি দিল্লির এক অংশের মুসলমান মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। আপের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে। তাই ২০১৪ সাল থেকে দিল্লির রাজনীতিতে পিছু হটতে থাকা কংগ্রেস কিছুটা হলেও অক্সিজেন পেয়েছে। এই সাফল্যটুকু খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে তারা ঘুরে দাঁড়াবে নাকি ফের তলিয়ে যাবে, সেটাই এখন দেখার।

মতামত ব্যক্তিগত।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.