শাওন
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট ভারতের ১০৩তম সংবিধান সংশোধনীকে বৈধতা দিল। এই সংশোধনীর মর্মবস্তু হল অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া উচ্চবর্ণের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে ও সরকারি চাকরিতে ১০% সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজনের ডিভিশন বেঞ্চ একমত হয়ে এই রায় দিতে পারেনি। পাঁচজন বিচারপতির মধ্যে দুজন বলেছেন, এই সংরক্ষণ যদি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যই হয়, তাহলে তফসিলি জাতি, জনজাতি (SC, ST) এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণিরও (OBC) এর আওতায় পড়া উচিত। বাকি তিন বিচারপতির যুক্তি, যেহেতু এমনিতেই SC, ST, OBC-দের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে, সেহেতু অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগণের মধ্যে SC, ST, OBC-র অন্তর্ভুক্তি অপ্রয়োজনীয়। শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত ৩:২ গরিষ্ঠতায় শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য বহাল হয়েছে।
মূলধারার বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় সকলেই এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। যেহেতু এই সংশোধনী ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগেই নিয়ে আসা হয়েছিল, সেহেতু প্রত্যাশিতভাবেই বিজেপি এই রায়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। কংগ্রেস এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে এর সঙ্গে সঙ্গে কাস্ট সেনসাস বা জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি তুলেছে। সিপিএম এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, বহুদিন ধরেই তারা এই দাবি করে আসছে। সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছে, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার যে মাপকাঠি তৈরি করা হয়েছে (অর্থাৎ বছরে আট লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়, পাঁচ একর পর্যন্ত জমি ইত্যাদি) তা অন্যায্য। রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি), জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) ইত্যাদি দলগুলোও মোটের উপর জাতিভিত্তিক জনগণনা চেয়েছে এবং এই সংরক্ষণের মধ্যে SC, ST ও OBC-দের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেছে। আবার প্রধান বিরোধী দল অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কজহগম (এআইএডিএমকে) বাদে শাসক দল দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কজহগম (ডিএমকে) সমেত তামিলনাড়ুর প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এই রায়ের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছে, সিপিআই-ও প্রায় তাই। অল ইন্ডিয়া মজলিশ-এ-ইত্তেহাদউল মুসলিমীন (এআইএমআইএম) দলও এই আইনের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় অনেকে মন্তব্য করছেন, সংরক্ষণ সবসময়েই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য হওয়া উচিত ছিল। এই প্রবন্ধে এই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সংরক্ষণের বৈধতা, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় এবং সংরক্ষণ সম্পর্কে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ভারতবর্ষের জাতিভেদ ব্যবস্থার অন্তর্বস্তু ও সংরক্ষণ
গোড়ার দিকে বর্ণাশ্রম ছিল এক ধরনের সামাজিক স্তরবিন্যাস। চারটি বর্ণে বিভক্ত সমাজে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) কোনো বর্ণের সদস্য শুধুমাত্র জন্মসূত্রেই হওয়া সম্ভব। বিবাহ অনুমোদিত ছিল শুধুমাত্র একই বর্ণের মধ্যে এবং কোনো মানুষের পেশা ও মর্যাদা সম্পূর্ণত তার বর্ণ দিয়ে নির্ধারিত হত। কোনো একজন ব্রাহ্মণ যদি জীবনধারণের জন্য দৈহিক শ্রম করত তাহলে তাকে জাতিচ্যুত হতে হত। শূদ্রদের কর্তব্য ছিল বাকি তিন উচ্চবর্ণের সেবা করা। দৈহিক পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শূদ্ররা অংশগ্রহণ করত এবং সেই উৎপাদনের উদ্বৃত্ত ভোগ করত উচ্চবর্ণের লোকেরা। এছাড়াও শূদ্রদের উপর নানা ধরনের অমানুষিক সামাজিক নিপীড়ন বহাল ছিল। পরবর্তীকালে বর্ণ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আসে। শূদ্ররা বিভিন্ন জাতি-বর্ণ, উপ-জাতি-বর্ণতে (sub-caste) ভাগ হয়ে যায়। প্রত্যেক জাতিই কোনো না কোনো পেশা দিয়ে চিহ্নিত। জাতি-বর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে যে জাতি যত উঁচুতে অবস্থান করে সেই জাতির লোকেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা তত উঁচু। ফলত, এই জাতি বিভক্তির সময় প্রত্যেক জাতিই যতটা সম্ভব উচ্চস্তরে আরোহণের চেষ্টা করেছে। উচ্চবর্ণে জন্মগ্রহণ করা কোন ব্যক্তি নিম্নবর্ণের শ্রমের ফসল আত্মসাৎ করতে পারবে। তেমনি নিম্নবর্ণে জন্মগ্রহণ করা কোনো ব্যক্তিকে দৈহিক শ্রমের মাধ্যমে জীবন ধারণ করতে হবে। নিম্নবর্ণের ব্যক্তির নিজস্ব প্রচেষ্টায় সামাজিক বা অর্থনৈতিক মর্যাদা লাভ করা সম্ভব নয়। ওই ব্যক্তি যে বিশেষ জাতির অন্তর্ভুক্ত, সেই জাতির সামগ্রিক উন্নতি ঘটলে তবেই ব্যক্তির উন্নতি সম্ভব।
ব্রিটিশ আমলে ১৭৯৩ সালে জমিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর উচ্চবর্ণগুলোর কর্তৃত্ব আরও জোরদার হয়। অর্থাৎ জাতি-বর্ণ ব্যবস্থার অন্তর্বস্তুই হল বংশানুক্রমিক শ্রম বিভাজন। অনেকে এই ব্যবস্থাকে অস্পৃশ্যতার সঙ্গে এক করে দেখেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ডঃ বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর যখন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে মাহাড় সত্যাগ্রহের ডাক দিয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিনায়ক দামোদর সাভারকর সেই সত্যাগ্রহকে সমর্থন করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের পর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কিছুটা বিকাশ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে জমিদারি ব্যবস্থার বিলুপ্তির ফলে পেশাগত ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়। যে জাতির মানুষ চামড়ার কাজ করতেন (চর্মকার), তাঁদের সবাই এখন আর চামড়ার কাজে যুক্ত নন। সব ধীবররা এখন মাছ ধরার কাজে যুক্ত নন অথবা ডোম জাতির সব মানুষ মৃতদেহ সৎকারের কাজে যুক্ত নন। অর্থাৎ পেশা দিয়ে চিহ্নিত জাতি, বর্ণের পরিবর্তন ঘটেছে। সামাজিক-নিপীড়নের মাত্রাও (যেমন অস্পৃশ্যতা) আগের চেয়ে কমেছে। কিন্তু জাতি-বর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যে বংশানুক্রমিক শ্রম বিভাজনের ব্যবস্থা হয়েছিল তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে? নিম্নবর্ণে জন্মগ্রহণ করার কারণে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পশ্চাৎপরতা, তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে? যে চর্মকাররা আর চামড়ার কাজ করেন না, দেখা যাবে তাঁরা এখন ইটভাটার শ্রমিক হয়েছেন অথবা নির্মাণ কাজের জন্য গ্রাম থেকে শহরে অত্যন্ত কম পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। এককথায় তাঁরা এখনো শস্তায় দৈহিক শ্রম দিচ্ছেন।
উচ্চবর্ণের মানুষ বর্তমানে কোন ধরনের পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন? মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট দেখিয়ে দিয়েছিল সরকারি আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইত্যাদি সমস্ত সম্মানীয় পেশায় উচ্চবর্ণের ব্যাপক আধিপত্য। সংরক্ষণের কারণে সরকারি শিক্ষা বা সরকারি চাকরিতে তবু কিছুটা নিম্নবর্ণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বেসরকারি সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন পেশাগুলোতে উচ্চবর্ণের দাপট আরও প্রকট। এলাহাবাদ শহরের নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে – যেমন বার অ্যাসোসিয়েশন, প্রেস ক্লাব, ট্রেড ইউনিয়ন, এনজিও, ছাত্র ইউনিয়ন ইত্যাদিতে প্রায় সবকটা জায়গা উচ্চবর্ণ (বিশেষত ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ) মানুষের দখলে, যদিও তারা জনসংখ্যার অত্যন্ত সামান্য অংশ। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজে সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন কাজগুলোতে উচ্চবর্ণের জন্য অলিখিত সংরক্ষণ আজও সুরক্ষিত।
আরো পড়ুন পদবি বিসর্জন শেষ কথা নয়, লড়াইয়ের সূচনা
যেহেতু জাতি-বর্ণগত অবস্থান একেবারে জন্মগত এবং অপরিবর্তনীয়, সেহেতু কোনো ব্যক্তির সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা নির্ভর করছে তার জাতি-বর্ণের মর্যাদার উপরেই। এই কারণেই ভারতের সংবিধানে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য সরকারি উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে বাধ্যতামূলক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জন্মগতভাবে নিম্নবর্ণ হওয়ার ফলে যে ঐতিহাসিক অবিচার ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু মানুষের উপর করে আসা হয়েছে, তার যৎসামান্য প্রতিকার করার উদ্দেশ্যে এই সংরক্ষণ চালু করা হয়েছিল। ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষ জাতি-বর্ণগত নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচার জন্য ধর্ম পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে যে ধর্ম পরিবর্তন করলেও জাতি-অবস্থানগত বঞ্চনা ও নিপীড়নের কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, নিম্নবর্ণের বহু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, কিন্তু সাচার কমিটির রিপোর্ট ও রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের রিপোর্ট দেখিয়ে দিয়েছে, ভারতে মুসলমানদের সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের থেকে কোনো অংশে ভাল নয়। সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময়ে মুসলমানদের কোনো সংরক্ষণের আওতায় রাখা হয়নি, ফলে তাঁদের দুর্দশা আরও বেড়েছে।
সুতরাং সংরক্ষণের সঙ্গে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কোনো সম্পর্ক নেই, কখনো ছিল না। অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনীয়, ধর্মীয় পরিচয়ও পরিবর্তনীয়। কিন্তু জাতি-বর্ণের পরিচিতি অপরিবর্তনীয়। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ব্যবহার করতে পারে। সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারে। বিভিন্ন আন্দোলনের চাপে সরকার কিছু জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করতে বাধ্যও হয়েছে, কিন্তু তার অধিকাংশেরই অবস্থা সঙ্গীন। সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য স্বাস্থ্য এত বছর পরেও দূরতর দ্বীপ হয়ে রয়েছে। বিধবা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য অপর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষার টাকাও কেটে নেওয়া হচ্ছে। স্কুলের মিড ডে মিলের বাজেটেও কোপ পড়ছে। এদিকে সংরক্ষণ দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতির আষাঢ়ে গল্প শোনানো হচ্ছে।
পরবর্তী অংশ আগামীকাল
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।