দেখতে দেখতে এসে গেল অগাস্ট মাস। এ বছর অবশ্য অগাস্ট অব্দি অপেক্ষা করতে হয়নি, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশ জুড়ে সাজ সাজ রবে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ অনেক আগে থেকেই পালন করা শুরু হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে স্বাধীনতা দিবসে প্রত্যেক বাড়িতে তেরঙা পতাকা উড়বে, দেশের মানুষ নতুন করে দেশকে ভালোবাসার শপথ নেবে ফেসবুকে জাতীয় পতাকাকে প্রোফাইল পিকচার করে। এমনটাই সরকারি পরিকল্পনা। ভারতে গৃহহীন মানুষের সংখ্যাই বেশ কয়েক লক্ষ। তারা কী করবে তা অবশ্য সরকার এখনো বলেনি। অবশ্য দেশের প্রান্তিক মানুষ যে ন্যূনতম স্বাধীন জীবনযাপনের সুযোগটুকু পাচ্ছেন না, তা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা আছে কিনা তা এই মহোৎসবের হট্টগোলে বোঝা যাচ্ছে না।
প্রতিবন্ধী আন্দোলনের প্রয়াত নেতা জাভেদ আবিদি একবার ঠাট্টা করে লিখেছিলেন, গান্ধীজি তো তা-ও পরাধীন দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রেনে উঠতে পেরেছিলেন, পরে তাঁকে জোর করে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের মত মানুষ, যারা হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারি না, তারা তো স্বাধীন দেশেও পরাধীন। কারণ আমরা কোনোদিন ভারতীয় রেলের পরিষেবা গ্রহণ করতে পারি না। নিজের দেশে চলাফেরা করার কোনোরকম স্বাধীনতাই আমরা পাই না। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধী মানুষ একথার প্রতিধ্বনি করেছেন। সাম্প্রতিককালে ভিরালি মোদী নামে একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মহিলা ভারতে চলাফেরা করার স্বাধীনতার অনুপস্থিতি সম্পর্কে নানা জায়গায় লেখালিখি করেছেন, বক্তব্য রেখেছেন। ভিরালি একইসঙ্গে নতুন কথাও আমাদের শুনিয়েছেন। প্রতিবন্ধী নারী হওয়ার কারণে তিনি আরও কী কী ধরনের বৈষম্যের শিকার হন সেকথা লিখেছেন। একবার মায়ের সঙ্গে তিনি ট্রেনে যাচ্ছিলেন। যেহেতু ভারতের ট্রেনে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষ নিজে উঠতে পারেন না দুজন কুলি মিলে তাঁকে ট্রেনে তুলেছিল। তিনি লিখেছেন, একজন মহিলা হিসাবে দুজন অপরিচিত পুরুষ তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করে সকলের সামনে ট্রেনে তুলছেন – এটা তাঁর কাছে অত্যন্ত অবমাননাকর এক অভিজ্ঞতা। আরও জানিয়েছেন, এই ধরনের সাহায্য যখন নিতে গিয়ে অনেকসময় তিনি যৌন হেনস্থার সম্মুখীন হন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁকে অযাচিত স্পর্শ সহ্য করতে হয়, কারণ ভারতের রাস্তায় চলাফেরা করার জন্য অচেনা মানুষের উপর নির্ভরশীল হতেই হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
একাধিক দৃষ্টিহীন মানুষ বারবার বলেছেন, তাঁরা আয়কর দিতে গিয়ে বাধা পাচ্ছেন, কারণ আয়কর দপ্তরের যে ওয়েবসাইট আছে তা দৃষ্টিহীনদের ব্যবহারের উপযোগী নয়। একজন ব্যাঙ্কের অফিসার অথবা একজন কলেজের অধ্যাপক যখন বলেন, আমার আয়কর আমি নিজে দিতে পারছি না, নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি অন্য মানুষের উপর, অবাক লাগে। কারণ এঁরা দৃষ্টিহীন হলেও নানা বাধা পেরিয়ে পড়াশোনা করেছেন, সরকারি চাকরি করছেন। অথচ দেশের নাগরিক হিসাবে আয়কর স্বাধীনভাবে দিতে পারছেন না, অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
কলকাতার এক কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র তার সেরিব্রাল পলসির সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে ভয় পাচ্ছে। এই ডিসেবিলিটি সার্টিফিকেট তাকে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নানা সুবিধা করে দিতে পারে। কিন্তু দেশের ন্যাশনাল ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী কোনো অভিভাবকের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার নিদানও চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে। এই ন্যাশনাল ট্রাস্ট আইন যেমন কয়েক ধরনের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ এবং তাদের পরিবারকে সাহায্য করে, তেমনি নানাবিধ অসুবিধাও সৃষ্টি করে। চেন্নাইয়ের প্রতিবন্ধী কর্মী রাজীব রাজন বারবার এই ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি শিক্ষিত ও উপার্জনশীল – একথা জানানোর পরও কোনও ব্যাঙ্ক তাঁর অ্যাকাউন্ট খুলতে রাজি হয়নি, কারণ তিনি সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাকে বারবার বলেন, তাঁর ‘গার্ডিয়ান’ (অভিভাবক)-এর সই লাগবে। অবশেষে মামলা করে তিনি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে সক্ষম হন। এই আইনের গার্ডিয়ানশিপ সংক্রান্ত নিয়ম পাল্টানোর দাবি বহু বছরের। কিন্তু সরকার এ সম্পর্কে কোনোরকম সদর্থক ভূমিকা নেয়নি।
আরো পড়ুন স্কুল খুলছে, কিন্তু প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের কী হবে?
প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ যে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারেন, সেটাই হয়ত ভারত সরকার বিশ্বাস করে না। যেটুকু স্বাধীনতা একজন নাগরিকের নিত্য প্রয়োজন, তা রাস্তাঘাটে চলাফেরা হোক বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা – তা নিয়ে নানাবিধ সমস্যার জট খোলার চেষ্টা তাই আজ অব্দি হয়নি।
পুরাণ অনুসারে সমুদ্র মন্থনকে কেন্দ্র করে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রথমে সন্ধি হয়েছিল। পরে অসুরদের সঙ্গে প্রতারণা করে দেবতারা অমৃত গ্রহণ করেন, অসুররা বাদ পড়ে যান। স্বাধীনতার এই অমৃত মহোৎসব থেকেও বাদ পড়ছেন অনেক প্রান্তিক মানুষ। বলাই বাহুল্য, এই বাদ পড়া ভুলবশত নয়, একেবারেই ইচ্ছাকৃত। সংবিধানের ১৫ এবং ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন করে যে যে ভিত্তিতে বৈষম্য অপরাধ, সেই তালিকায় শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে দুটো প্রাইভেট মেম্বার্স বিল আনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। ভারত সরকার স্বাধীনতার ৭৫ বছরে কাজের কাজ করার বদলে দেখনদারির দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।