বামফ্রন্টের সাথে জোটে যোগ দেওয়ার পর থেকেই ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আই এস এফের বিরুদ্ধে নানা মহল থেকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তোলা হচ্ছে। অথচ নেতা আব্বাস সিদ্দিকি যে রাজনীতির কথা বলছেন বা আই এস এফ যে রাজনীতির কথা বলছে, সেখানে কিন্তু শুধু মুসলমানদের কথা বলছে না তারা। বলছে সমস্ত পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা। তাদের মূল বক্তব্য হল, মূলধারার দলগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আদিবাসী বা তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে তাদেরই রাজনৈতিক মুখ করে, যারা লেখাপড়া কম জানে এবং অযোগ্য, ফলে দলদাস হয়ে থাকতে চায়। আব্বাসের আওয়াজটা তার বিরুদ্ধেই। এরকম লোকেদের দিয়ে কোন সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন হবে না। যোগ্য মানুষকে যদি রাজনৈতিক মুখ করা হয়, তবেই তারা সকলের ক্ষমতায়নের কথা ভাবতে পারে। আব্বাস যে আওয়াজ তুলেছেন সেটা কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, পিছিয়ে পড়া সকলের জন্যই।

আই এস এফ যেদিন কলকাতা প্রেস ক্লাবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করল, সেদিন যে প্রচার পুস্তিকা তারা দিয়েছিল, তাতেও তা-ই লেখা ছিল। আদিবাসী, তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু (শুধু মুসলমান নয়, খ্রীষ্টানও), ভাষাগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে থেকে প্রতিষ্ঠিত দলগুলো একটা-দুটো পরিবারকে বেছে নিয়ে তাদের রাজনৈতিক মুখ করে সাধারণত। কিন্তু যারা ঐ সম্প্রদায়ের সত্যিকারের লেখাপড়া জানা লোক, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির লোক, সম্প্রদায়ের প্রতি যাদের দরদ আছে — তাদের রাজনৈতিক মুখ করা হয় না। কারণ এইসব চেতনাসম্পন্ন মানুষকে মুঠোর মধ্যে রাখা যায় না। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অযোগ্য লোককেই মূলধারার দলগুলো জায়গা করে দেয়। আব্বাস এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলেছেন। তিনি নিজে নির্বাচনে প্রার্থীও হবেন না শোনা যাচ্ছে। পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলোর শিক্ষিত মানুষ যাঁরা, তাঁদের প্রার্থী করবেন। সুতরাং এটা বহুজনের আওয়াজ। এর গায়ে ধর্মীয় ট্যাগ লাগানো ঠিক হবে না।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

যেসব ইসলাম ধর্মাবলম্বী উদার জীবনযাপনের জন্য নিজের ধর্মের লোকেদের দ্বারাই সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েন, তাঁদের লড়াই আই এস এফের উত্থানে পিছিয়ে পড়বে, এমন কথা কেউ কেউ বলছেন। কিন্তু এই ধারণা অমূলক। কারণ কেবল আব্বাস সিদ্দিকি নয়, যে কোন সুফি দরবেশ যে ইসলাম প্রচার করেন বা যে ঐস্লামিক ন্যায়ের ধারণা তাঁরা দেন, সেখানে জীবনযাত্রার উপরে নানাবিধ বিধিনিষেধ চাপানোর কোন ব্যাপার নেই। যেমন মহিলাদের বোরখা পরার বাধ্যবাধকতা নেই। পশ্চিমবঙ্গে সুফি দরবেশরা কখনোই বোরখা পরতে বলেননি। গ্রামবাংলাতেই তাঁদের প্রভাব বেশি, শহরে নয়। তাই সেখানে চট করে বোরখা দেখা যায় না, দেখা যায় কলকাতা শহরে। ফুরফুরা শরিফ একশো বছরেরও বেশি পুরনো। সেই দাদা হুজুরের সময় থেকে ফুরফুরার প্রভাব যে অঞ্চলগুলোতে, সেখানকার মুসলমান মহিলাদের তো বোরখা পরতে দেখি না।

আব্বাস সিদ্দিকি আওয়াজ তুলছেন যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের জন্য। এখানে ধর্মীয় পোশাক বা আচার আচরণ চাপিয়ে দেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। আব্বাস নিপীড়িত, নির্যাতিত, অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায় করার কথা বলছেন এবং তা বলছেন সংবিধানের ভাষায়, ধর্মের ভাষায় নয়। একসময় হয়ত ধর্মগুরুদের ভাষায় কথা বলেছেন, কিন্তু রাজনীতিতে প্রবেশ করে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেই কথা বলছেন। তা না হলে শিমূল সোরেনকে কেন দলের সভাপতি করবেন? দলের অন্যান্য নেতাদের মধ্যেও অনেকেই আদিবাসী এবং তফসিলি জাতি, উপজাতিভুক্ত লোক।

অনেকে বলছেন আব্বাসকে বামেরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মুসলমান সমাজে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বা ফুরফুরারই ত্বহা সিদ্দিকির যতটা প্রভাব, ততটা আব্বাসের নেই। এই কথাগুলো ২৮শে ফেব্রুয়ারির পরে আর বলার কোন মানে হয় না। ব্রিগেডে যত মানুষ এসেছিলেন তার পঞ্চাশ শতাংশ আব্বাস সিদ্দিকির সমর্থক। তাছাড়া ওঁর যে ভিডিওগুলো সোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে একেকটার ভিউ ৫-৭ লাখ। অথচ সিদ্দিকুল্লা সাহেব বা ওরকম অন্য যাঁরা আছেন, তাঁদের ভিডিওগুলো ৫-৭ হাজার ভিউও পায় না। ওঁরা ব্রিগেডে ওভাবে সমর্থক এনে মাঠ ভরিয়ে দেখাতে পারবেন না। এর আগে অন্য দলের ব্রিগেডে সিদ্দিকুল্লা সাহেব, ত্বহা সিদ্দিকিরা তো ছিলেন। ২৮শে আব্বাসকে ঘিরে যে উন্মাদনা দেখা গেল তেমন তাঁদের নিয়ে দেখা যায়নি। ফুরফুরা এতদিন কোন দলকে ভোট দিতে বলে সেই দলের থেকে নানা সুযোগ সুবিধা আদায় করত। আই এস এফ তৈরি করে আব্বাস সেই দালালির সংস্কৃতি থেকে ফুরফুরাকে মুক্ত করছেন।

এই উপমহাদেশ দুরকম ধর্মীয় নেতাই দেখেছে। নিজেকে পিছিয়ে পড়া মানুষের ত্রাতা বলে দাবি করে নিজের গাড়ি বাড়ি করেছেন অথচ গরীব মানুষ যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেছে, এমন নেতা ছিলেন। আবার খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি, দাদা হুজুরদের মত সুফি সন্তরাও ছিলেন, যাঁদের অতি সাধারণ জীবনযাপনের জন্য অন্য ধর্মের গরীব মানুষও তাঁদের ভক্ত হয়েছেন। আধুনিক যুগের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও এই দুরকম নেতাই দেখা গেছে। আব্বাস দারুণ ভাল এমনটা বলার সময় আসেনি, আবার তাঁকে খারাপ বলে উড়িয়ে দেওয়ারও সময় হয়নি। আমাদের নজর থাকবে তিনি সাংবাদিক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কবি হসরত মোহানি বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা মওলানা ভাসানির মত সত্যিই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে পারেন কিনা। নিজের জীবনযাত্রা তাঁদের মতই সাদাসিধে থাকে কিনা। সেসব দিয়ে আব্বাসের রাজনীতির বিচার হবে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.